এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

অমিতাভ প্রহরাজ



বেবীটক্





সাধ্যসাধনা বনাম সাধনাসাধ্য


তপস্যা করলে কতদূর কি পাওয়া যেতে পারে তার কোন মা-বাপ নেই। আর সেই রেকর্ডেড প্রাপ্তিগুলির লিস্টি দেখলে তার ভ্যারাইটিতে যেকোন বড় শপিং কমপ্লেক্স লজ্জা পেয়ে যাবে, গ্যারান্টি। কখনো, মাটিতে, জলে, বাতাসে, ল্যান্ড-ওয়াটার-এয়ার, মানুষ-জন্তু,জানোয়ার-দেবতা, তিনটেতেই এবং তিনটে থেকেই ডেথ প্রুফ হবার আশীর্বাদ, তার সঙ্গে ফ্রি পেয়েছিল যেকোন অস্ত্র থেকে ইনজ্যুরি-প্রুফ এবং দিন বা রাত, যেকোন টাইম ডেথপ্রুফ। (রাক্ষস হিরণ্যকশিপু মনে আছে তো? আরে পেল্লাদ মানে প্রহ্লাদের বাপ, সে পেয়েছিল বিষ্ণুর কাছ থেকে এ জিনিস। এক্কেবারে প্রথমে দুজন লেডিজ ছিল, দিতি আর অদিতি। সেই দিতির ছেলে হিরণ্যকশিপু, ভাই হিরণ্যাক্ষঃ) কখনো বছরের পর বছর তপস্যা করে পাতি তীর-ধনুক, কখনো আবার তাও নয়, শুধু তীর (আমাদের মহাভারতের মহান গান্ডু কর্ণ)। কখনো বাচ্চা হচ্ছেনা, তপস্যা করে স্পার্ম তাও দেবতাদের পেয়েছে এমনও এক্সাম্পল আছে!! মহাভারতের কুন্তী!! তাও আবার একটা ডোনার হলে হতো, তা না পাঁচ পাঁচটা ডিফারেন্ট ভি.ভি.আই.পি. ডোনার!!! সূর্যদেব, বরুন, ইন্দ্র, পবন ইত্যাদি। সাধে পাণ্ডুর রঙ পাণ্ডুর??!! কখনো আবার তপস্যা করে কিছু চাইনা, পেছনপাকা ছেলে, আই এ এস এন্ট্রান্স লেভেলের প্রশ্ন করে (নচিকেতা, যমকে)।
এই তপস্যা বর টপিকটা আরেকটু বলার আছে। শুধু জুলুমবাজি আর বিচিত্রতা নয়, একটা বিরাট দর্শনের জায়গা এর মধ্যে আছে যা শুধুমাত্র হিন্দু দেবদেবীদের প্রসঙ্গে প্রযোজ্য তা নয়। এটা কি জানা আছে? জ্বর, মানে ফিভার আর কি, কোন রোগ নয় একসময় একটা রাক্ষসের নাম ছিল!! আর ততোধিক বিচিত্র ও ব্যাঞ্জনাময় তার কাহিনী। ওই যে হিরণ্য রাজার কথা বলেছিলাম, ওর পেল্লাদ ছাড়াও আরেকটা ছেলে ছিল, সংহ্লাদ। বেচারা বাপের মার্ডার দেখে ভয়ে সমুদ্রের তলায় বাস করতো। তার ছেলের নাম পঞ্চজন। একটা শাঁখ বানিয়ে তার মধ্যে থাকতো। তাকেও মার্ডার করেছিল কৃষ্ণ, তাও একায় কুলোয়নি বরুণের হেল্প নিয়ে। স্রেফ একটা শাঁখ নেওয়ার জন্য বেমালুম পঞ্চজনকে মার্ডার করে ফেললে!!! সেই শাঁখটাই কুরুক্ষেত্রের টপ টপ শাঁখের মধ্যে টপেস্ট ব্র্যান্ডের শাঁখ, পাঞ্চজন্য।

যাকগে এই পঞ্চজনের লতায় পাতায় আত্মীয় জ্বর, একজন অসুর। সনাতন পূজা পদ্ধতিতে জ্বরএর পূজার কথা আছে। এঁর ধ্যানমন্ত্র হলো"জ্বরস্ত্রিপাদস্ত্রিশিরঃ ষড়ভুজো নবলোচনঃ"-
জ্বরের তিন পা, তিন মাথা, ছয় হাত, নয় চক্ষু।
এবার মজার কথা যুদ্ধ করতে আসা জ্বরের যে বর্ণনা রয়েছে তা অবিকল জ্বর-আক্রান্ত রোগীর দেহে যে লক্ষণ ফুটে ওঠে। সেম কেস ঊষার ক্ষেত্রে, দেবী উদয় হওয়ার সময় যে রূপের বর্ণনা তা অবিকল ঊষাকালের বর্ণনা। এবার মন দিয়ে শুনুন কি ভয়ঙ্কর গণ্ডগোলটা বাধলো।
প্রশ্ন উঠলো কোনটা আগে? জ্বর বা ঊষার রূপ প্রত্যক্ষ করে সেখান থেকে জ্বরাসুর বা ঊষাদেবীর সৃষ্টি না তার উলটো? এবং কেলো গেল আরো গভীরে। জ্ঞানের রূপ শুভ্র, মালিন্যহীন। তাহলে তপস্যার ফলে যে সরস্বতী উদ্ভূত হলেন ব্রহ্মার উরু থেকে (এ এক মহা স্ক্যান্ডাল আছে, সরস্বতী ব্রহ্মার মেয়ে কাম বৌ বোথ, গভীরে না যাওয়াই ভালো) তিনি "সর্বশুক্লা", "শশধরকরবর্ণনা", এটা আগে না জ্ঞান আগে? মানে জ্ঞান সাদা বলে সরস্বতী ফর্সা না সরস্বতী ফর্সা বলে জ্ঞান সাদা?

পশ্চিমের কেষ্টবিষ্টুরা বলেন প্রথমটা ঠিক। মানে আগে জ্বর বা জ্ঞানের কনসেপ্ট এসেছে, সেই কনসেপ্ট বলে জ্ঞান ফর্সা বা জ্বর উষ্ণ। এবার সেখান থেকে দেব দেবীর অলৌকিক রূপগুলি কল্পনা করা হয়েছে।

পূরব এটা মানতে নারাজ। এটা হলে তো বেদ অপৌরুষেয় নয়। ঈশ্বরতত্ত্ব খারিজ হয়ে যায়। এবার ঈশ্বরতত্ত্ব কোথায় টাকডুম করছে দেখুন। পুরাণে জ্বরকে"রুদ্রনিঃশ্বাসসম্ভূতঃ"বা শিবের নিশ্বাস থেকে জন্ম বলা হচ্ছে। এটি স্পেশাল, শৈব-জ্বর। কৃষ্ণ, বলরাম শৈব-জ্বর আক্রান্ত হয়েছিলেন। কৃষ্ণ মহা খচে গিয়ে জ্বরাসুরকে যেই টপকে দিতে যাচ্ছেন, এমন সময় আকাশবাণী বলে উঠলো "থামো, থামো, মেরোনা"।
কেন মেরোনা?
খুব মন দিয়ে যুক্তিটা শুনুন। জ্বর একটি শক্তি। পীড়াশক্তি। ব্যাধিশক্তি। জ্বর না থাকলে পীড়া বা কষ্ট থাকবেনা। পীড়া না থাকলে ভোগ বা উপভোগের কনসেপ্ট থাকবেনা। এবার মানুষ কর্মপ্রবণ প্রাণী। কর্ম করছে। এবং কর্মফল পাচ্ছে। কর্মফল একটা এনার্জি, যা কনভার্ট হয়ে যাচ্ছে উপভোগ অথবা পীড়ায়, কর্মের প্রকৃতি অনুযায়ী। দুটো কম্বাইন্ড হচ্ছে ভোগ। এবার কর্মফলকে ভোগে কনভার্ট হতেই হবে। নাহলে তা খরচ হবেনা, জমতে থাকবে। এবং জমতে থাকলেই সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী একসময় এতটা কর্মফল জমে যাবে যে কর্মফল দিয়ে কর্ম ঘটানো যাবে, বা কর্ম আপনা থেকে ঘটবে, মানুষকে কর্ম করতে হবেনা অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য।
এবং এই স্টেজটাতো দেবত্ব!!! মানুষ দেবতা হয়ে যাবে!!!! এটা কখনোই হতে দেওয়া যায়না, দেবতাদের অস্তিত্বে সংকট এসে যাবে। তাই জ্বর দরকার। কর্মফল কনভার্ট হয়ে যাবে জ্বর না হওয়ায় বা পীড়িত না হওয়ায়, যা একটি উপভোগ। এবং উপভোগের দ্বারা কর্মফল খরচ হবে, জমবে না। আর দেবতার ইনসিকিউরিটি, মানুষ যদি দেবতা হতে শুরু করে, কেটে যাবে!!

এই স্ক্যান্ডাল কি করে রিভিল হলো শুনুন।

তখন কৃষ্ণ ভার্সেস শিব ফাইটিং হচ্ছে। রেয়ারেস্ট অফ থে রেয়ার সিচুয়েশন। ঘটনাটা কি? না, তপস্যা করে শিবের পুত্র হওয়া বাণ রাজা কৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধকে কিডন্যাপ করেছে। কারণ, বাণের মেয়ে ঊষা স্বপ্নে দেখেছে ওই অনিরুদ্ধ ওর সাথে খারাপ কাজ করছে। সেই এ্যাডাল্ট স্বপ্ন থেকে লাভ এবং দিওয়ানা অনিরুদ্ধ ঊষার বেডরুমে অবধি পৌঁছে গেছে। খবর পেয়ে ঊষার ড্যাড বাণ জ্বলে উঠেছে। বাণের হাজারটা হাত, শিবের ছেলে, কার্তিকের ভাই, যা তা লেভেলের ডন। তার মেয়ের সাথে লাইন তাও বাড়িতে ঢুকে?!! বাণ জাস্ট অনিরুদ্ধকে সরিয়ে দিতে চায়, নিজের দৈত্য আর্মি ডেকেছে। অনিরুদ্ধ যে সে লেভেলের আশিক নয়, কৃষ্ণের নাতি, প্রদ্যুম্নের ছেলে, ধক বিশাল। কিছু না পেয়ে ঊষার বেডরুমের একটা দরজার খিল উপড়ে নিয়ে ফাইটিং। বত্রিশ রকম কায়দায় ফাইট হচ্ছে, ভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, লুপ্ত, বিলুপ্ত, আপ্লুত ইত্যাদি।(শব্দগুলো লক্ষ্য করুন, এখানে এগুলোর একটারও মানে নেই কিন্তু, প্রত্যেকটা প্রপার নাউন। এগুলোর সাথে মানে যোগ হয়েছে অনেক পরে)যাকগে আল্টিমেটলি চোট্টামি করে সেন্সলেস করে গুম করে দিয়েছে বাণ। তো কৃষ্ণ এসেছে বাণকে খতম করতে আর শিব মহারাগে রেগে গিয়ে ছেলেকে বাঁচাতে এসেছে...
তখনই বায়োলজিক্যাল ওয়ার শুরু করে শিব, শৈব জ্বর দিয়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে এল এক অদ্ভূত অসুর, তিন পা, তিন মাথা, ছয় হাত, নয় চোখ। সে ঘন ঘন হাই তুলছে আর তার দেহ থেকে উষ্ণ ভাপ বেরোচ্ছে, চোখে ঘুম কিন্তু ছটফট করছে (বর্ণনাটা খেয়াল করুন)। সে এক ভল্ল ছুঁড়ে মারলো বলরামকে, বলরাম জ্বরে কাবু হলেন। কৃষ্ণ তখন রেগে জ্বরাসুরকে মারতে গেলে আকাশবাণী বারণ করে"মা বধীর্জ্বরমেনং তু, রক্ষণীয়স্তয়ানঘ", অর্থাৎ"হে অনঘ, একে মারবেননা, একে রক্ষা করা আপনার কর্তব্য"। কারণটাতো বললাম একটু আগে। কৃষ্ণ বৈষ্ণব-জ্বর তৈরী করে ছেড়ে দিল। বৈষ্ণব ফিভার শৈব ফিভারকে মেরে ফাটিয়ে দিল। এবং ঘটলো দেবজগতের এক ঐতিহাসিক ঘটনা। শিব কৃষ্ণের কাছে এক রাউন্ড হেরে গেলেন!! পুরাণের টপ সিক্রেট ইনফর্মেশান এটা। এই তথ্য মানুষের কাছে আসার কথা নয়, কিন্তু কৃষ্ণর গাড়ী কাম ড্রাইভার দুটোই একসঙ্গে ছিল বিহঙ্গরাজ গরুড়, তার থেকে ইনফর্মেশন লিক করে চলে এসেছে হরিবংশপুরাণে, তারই রিপোর্ট থেকে এই কীটস্য কীট বেবির জুলিয়েন এ্যাসাঞ্জ হওয়া।
যাকগে, রুদ্রদেব মহাদেব বাঘছালের হাফপ্যান্ট পরে বিস্তর লম্ফ-ঝম্ফ করছিলেন কৃষ্ণকে চুন চুনকে মারুঙ্গা বলে, তখন এই মারপিটের মঞ্চ অর্থাৎ পৃথিবী, বসুন্ধরা বেজায় ভয় পেয়ে ব্রহ্মার কাছে ছুটলেন, এই দুই পাগলা-সি কে থামান, আমার যে হাড়গোড় ভেঙে গেল। এই স্টেজ ভেঙে গেলে ডেকরেটরকে অগাধ টাকা দিতে হবে। তো দাদু চললেন শিবের কাছে প্রথমে। ওই টাল্লুকে বোঝানো সহজ, সেন্টু দিলেই হবে। বললেন,

আপনার কি বেশী নেশা হয়ে গেছে? বাড়ির লোকজনের সঙ্গে ঘুষোঘুষি করছেন!!

কোন শালা বলে আমার নেশা হয়েছে??

আমি বলছি, ব্রহ্মা,"ন চ বুধস্যি কৃষ্ণং ত্বম আত্মানাং তু দ্বিধা কৃতম", "আপনি কি বুঝছেননা কৃষ্ণ আপনার দ্বিতীয় সত্তা?"

ব্যাস যায় কোথায়, কৃষ্ণকে জড়িয়ে "বস, মিস্টেক হয়ে গেছে, মিস্টেক, মিস্টেক, সরি" বলে মহাদেব ওখান থেকে কৈলাসের পথে, যাওয়ার পথে একটা হুঙ্কার
"কই রে নন্দি, আনোয়ার শাহ্‌ থেকে খান দশেক পুরিয়া তুলে আনিস তো, স্বপনের ঠেক থেকে আনবি, ওতে বীচি কম"।

এরপর বাণ শক্তি কাপুরের মতো মার খেল কৃষ্ণের কাছে, অনিরুদ্ধকে ট্যাংরার সাপের বিষের নেশা করিয়ে হ্যালু করে রাখা ছিল, ওকে চড়-থাপ্পড় মেরে সেন্সে এনে, হিরোইন ঊষার সাথে রিস্তানাতা করে দলবল দ্বারকায় ফিরলো, সে অন্য গল্প। এই অতিকায় ভ্যাজর ভ্যাজর করার কারণ আছে। হরিবংশপুরাণের এই ঘটনা শুনলে মনে হয়না আব্বাস মুস্তানের স্ক্রিপ্ট??

এখানে কতগুলো মারাত্মক কনসেপ্ট আছে। জ্বরের উপাখ্যান হচ্ছে প্রমান এই দেবতা মানুষ ক্লাসিফিকেশানে টিপিক্যালি পাওয়ারের ন্যাংটো প্রদর্শন। অলৌকিকত্বের উদ্ভব আর কিছু নয়, আসলে বিশাল মানব অমনিবাসকে দাবিয়ে রাখার কৌশল। জ্বর, ঊষা, অগ্নি, পবন এরা লৌকিক স্বাভাবিক জিনিস যাদেরকে আকার আকৃতি স্বভাব ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে জ্ঞানের নাগালের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে।

সরস্বতীর হাতে বীনা কেন? আর কিছুই না, বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা থেকে ফোকাসটা সরিয়ে রাখা মানুষদের কাছে।

কিন্তু সব কিছুরই একটা ভালো দিক , প্রায়ই পূর্ব দিকের খুব কাছাকাছি, থাকে। অলৌকিকত্ব, এ্যাজ এ হোল একটা কনসেপ্ট। এটা ইচ্ছে করে, শখে গ্রো করেনি। এটা আসতে বাধ্য হয়েছে। কারন এমন একটা বিভাজনের কথা ভাবো যা হচ্ছে ইটারন্যাল। ভাবো আলাদাপন এর কথা। এখান থেকে জন্ম নিল গোটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ড্রাইভার, "সত্য"!!! সত্যির কনসেপ্ট আগে ছিলই না। ঠিক যেমন একসময় ছাপার অক্ষরে যা কিছু তাকে সত্যি বলে ভাবতো মানুষ। বইতে ছাপা আছে মাথার মধ্যে বাঁশবন আর পান্ডারা দলবেঁধে থাকে আর থাকে প্যান্ডোরাপাড়া, মাথার রেড-লাইট-এরিয়া। এটা কখনোই ভুল হতে পারে? একইরকম, একসময় ঘটনা এবং তথ্য মাত্রেই সত্য ধরা হতো। ভুল বললাম, সত্য নয়, বিশ্বাসযোগ্য মানা হতো। যা নেই, যা নয়, যা হয়না, তার অস্তিত্বই নেই মাথার মধ্যে। তার অস্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য মনকে একটা ভার্জিন কাজ দেওয়া হলো, কল্পনা। কল্পনা আর মিথ্যের মধ্যে একটা সরু রেখা আছে


অমিতাভ প্রহরাজ

No comments:

Post a Comment