এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

জয়িতা ভট্টাচার্য




প্রবন্ধ



জীবনানন্দ দাশের কাব্যজীবনে কবি কুসুমকুমারী দাসের প্রভাব


জীবনানন্দ দাশ আজ শুধু এক কবির নাম নয় " জীবনানন্দ "__ সাহিত্যের এক ব্যতিক্রমী ধারার নাম ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যাকে বলেছেন কবি সম্রাট ,সেই কবিই জীবিতকালে প্রতিপদে হেনস্থার শিকার হয়েছেন ।উপেক্ষিত কবির কবিতায় এসেছে নিসর্গ ,এসেছে ব্যর্থ প্রেম এসেছে অবসাদ ।মৃত্যুর পর তাঁর কবিতা নিয়ে মুগ্ধতা ও উন্মাদনা বেড়েই চলেছে ।
জীবনানন্দের সাহিত্য ও নিজ জীবনে যে দুই নারী সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছেন তারা হলেন কবির মাতা কবি কুসুমকুমারী দাস ও তাঁর পত্নী লাবণ্য দাশ ।
গবেষকদের মধ্যে কবির ওপর জননীর প্রভাব সম্পর্কে প্রথম ইঙ্গিত করেন হূমায়ুন কবির তাঁর প্রবন্ধ " সাম্প্রতিক জীবনচেতনার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনানন্দ দাশের কবিতার রূপরেখা "প্রবন্ধে ।

জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাসের নাম অধুনা বিস্মৃত হলেও ।এক সময় তিনি ছিলেন জনপ্রিয় কবি ও ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ।তাঁর "আদর্শ ছেলে" কবিতাটি অনেকেই কৈশোরে পাঠ্যবইয়ে পড়ে থাকবেন :
     " আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
        কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে "

জীবনানন্দের প্রথম মূদ্রিত  কবিতা (ব্রহ্মবাদী,বৈশাখ ১৩২৬)"বর্ষ _আবাহন" ইংরেজিতে তর্জমা করে ক্লিন্টন বি সিলি মন্তব্য করেছেন ,"The first of Jibanananda's poems shows considerable influence ,though he would not proceed for long in
that direction"
জীবনানন্দ নিজে এক চিঠিতে লিখেছেন ,
" মা অনেক কবিতা লিখেছেন ।সে সব কবিতার সাদা ঝরঝরে শব্দ  নিক্কণ ও আশ্চর্য অর্থ সঙ্গতি বরাবরই আমাকে প্রলুব্ধ করেছে ,কিন্তু তবুও আমি প্রথম থেকেই অন্য পথ ধরে চলেছি " ।
বস্তুত কুসুমকুমারী দেবীর নিসর্গ প্রেম মূলক কবিতা গুলি দ্বারা জীবনানন্দ আজীবন প্রভাবিত হয়েছেন ।দুজনের কবিতা পাশাপাশি পড়লে এই মিল পাওয়া যাবে ।
তবে কুসুমকুমারীর কবিতা মূলত ঈশ্বরভক্তির ধর্ম সম্পর্কে জীবনানন্দের প্রথম থেকেই নিস্পৃহতা লক্ষ্য করা যায় ।এই বিষয়ে মাতা পুত্রের সাহিত্য পথ ভিন্ন ।
কুসুমকুমারীর জীবনীকার ডঃ.সুমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন,
," কুসুমকুমারীর সূত্রেই লোক জীবনের নিবিড় নৈকট্য আর লোকায়ত অভিব্যক্তির অত কাথাকাছি যেতে পেরেছিলেন তিনি । যার ফলে তাঁর কবিতা অন্যান্য আধুনিক কবিতার চেয়ে আলাদা চেহারা পেয়েছে "
   কুসুমকুমারী দাশ একদা জনপ্রিয় কবিতার এক অজানা কবি ।জন্ম বরিশাল ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দ ,মা ধনমণি দেবী এ পিতা চন্দ্রনাথ দাস যিনি নিজেও কবি ছিলেন ।কুসুমকুমারী তিন সন্তানের জন্মদাত্রী ।জীবনানন্দ(১৯৯৯),অশোকানন্দ(১৯০১)ও সুচরিতা (১৯১৫)।
কুসুমকুমারীর কর্মজীবন বিস্ত়ৃত না হলেও তাঁর শ্বশুরালয়ে ব্রাহ্মসাজের উদ্যোগে "নীতি বিদ্যালয় "নামে একটি স্কুল খেছিলেন ।কুসুমকুমারী এই বিদ্যালয়ে প্রত্যক্ষ়ভাবে জড়িত ছিলেন ।এছাড়াও আর্তের সেবায় তিনি ছিলেন সদা তত্পর ।রাজা রাম মোহন রায় ,মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ তথা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি তাঁর প্রগাঢ় ভক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ।
প্রাথমিক পাঠ শেষ করে তিনি কলকাতায় বেথুন স্কুলে ভর্তী হন ।
মায়ের মেধা ও পড়াশুনো সম্পর্কে  কবি পুত্র লিখেছেন ,
     " আমার মা শ্রীযুক্তা কুসুমকুমারী দাস.....কলকাতার বেথুন স্কুলে পড়তেন ।খুব সম্ভব ফার্স্ট ক্লাস অবধি পড়েছিলেন তারপরেই তার বিয়ে হয়ে যায় ।তিনি অনায়াসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায়
খুব ভালোই করতে পারতেন ,এ বিষয়ে সন্তানদের চেয়ে তাঁর বেশি শক্তি ছিলো মনে হচ্ছে ।"
পুত্রের মধ্যে দিয়ে মায়ের পূর্ণতা লাভের সুপ্ত ইচ্ছা বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে ।

জীবনানন্দ ও তাঁর বোন সুচরিতা দাশের
ছোটো বেলার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় কুসুমকুমারী দেবী নিয়মিত সাহিত্য  পাঠ ও আলোচনায় সক্রিয় অংশ নিতেন ।কবি তঁার মায়ের মুখে শেলী ,ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ ,ব্রাউনিং থেকে বৈষ্ণব পদাবলী ও রবীন্দ্রনাথ পড়ে ও ভালোবেসে নিজের কবি মনকে সুশিক্ষিত ও সতন্ত্র করে তুলেছিলেন ।
এর থেকে আন্দাজ করা যায় কুসুমকুমারী দাস তাঁর কবিপুত্রের জন্য একটি অনূকুল সাহিত্য পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছিলেন ।
তাঁর শিক্ষা ,সহবত ,সাহিত্যরুচি ও মানবমনের পূর্ণ বিকাশ সম্পর্কে কুসুমকুমারীর ছিল সদা সতর্ক দৃষ্টি ।

সুচরিতা দাশের কথায় ,"তিনি ছিলেন দাদার জীবনে সেই পল্লবঘন স্নিগ্ধ ছায়াছন্ন তরুশাখা___যাতে লগ্ন হয়ে একটি কোমল কাতর লতিকা বেড়ে ওঠে ,ফুল সম্ভারে  বিকশিত হয় ।"
কুসুমকুমারী দাস ১৯৪৮সালের ডিসেম্বর মাসে মারা যান ।
ব্রহ্মবাদী,মুকুল,বঙ্গলক্ষ্ণী,বামাবোধিণী,প্রবাসী ইত্যাদি পত্রিকায় লিখতেন নিয়মিত ।তিনি একটি শিশুতোষ গ্রন্থ ,কবিতা মুকুল নামে কাব্যগ্রন্থ,ও পৌরাণিক আখ্যায়িকা গদ্যগ্রন্থ ও স্মৃতিসুধা নামে আত্মজীবনী (অসম্পূর্ণ) লিখেছেন ।

সুমিতা চক্রবর্তী লিখেছেন ,জীবনানন্দের কবিতায় মানুষের বেদনায়,একাকিতত্বে নিষ্ঠুরতায়,নীচতায় ,কৃত্রিমতার কষ্টে বিষণ্ণ,ক্লান্ত ও শেষের দিকে বিদ্রুপ শানিত যে জীবনানন্দকে পাওয়া যায় সেই মানব ধর্মের প্রাথমিক বোধটি তাঁকে দিয়েছিলেন মাতা কুসুমকুমারী দেবী ।
বস্তুত কেবলমাত্র ইয়েট্স বা এজরা পাউন্ড নয় তাঁর সততা ,প্রজ্ঞা ও আদর্শিকতা তিনি অনেকটাই পারিবারিকসূত্রে অর্জন করেছিলেন ।তাঁর কবিতায়  সত্যেন্দ্রনাথ দাস,কুসুমকুমারী দাস ও জগদীশ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাবও অনেকটাই লক্ষ্য করা যায় একথা কম আলোচিত হলেও প্রত্যক্ষ করা যায় প্রাথমিক কবিতাগুলি লক্ষ্য করলে ।
জীবনানন্দ তাঁর মায়ের সাহিত্য প্রজ্ঞাকে কতটা সমীহ করতেন তার একটি দৃষ্টান্ত ,
১৯২৫ এ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে তত্কালীন সিটি কলেজের তরুন শিক্ষক "প্রায়_প্রথম " নামে কবিতাটি মাকে পাঠিয়েছিলেন মতামত প্রার্থনা করে ।কুসুমকুমারী ফেরত ডাকেই লিখে পাঠালেন," চিত্তরঞ্জন সম্পর্কে লিখেছো ভালোই করেছো ,কিন্তু তোমাকে রামমোহনের ও মহর্ষির ওপর লিখতে বলেছি ।"
কবির ওপর জননীর প্রভাবের একটি নিদর্শন ,তাঁর শিশু বয়সের লেখা অপ্রকাশিত একটি ছড়া ।
            ছড়া
"পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো
এলো----বৃষ্টি বুঝি এলো
ছিপ ফেলে বাথানের দিকে ওই চলে যায় কেলো
এলো----বৃষ্টি বুঝি এলো ।
-------------------------------------"-ইত্যাদি ।
                (গোলাম মূর্শেদের সৌজন্যে)
বস্তুত কুসুমকুমারীর আপন সংগ্রহে যে পরিমাণ গ্রন্থরাশি ছিলো সচরাচর কোনো সাধারন পাঠাগারে পাওয়া যায়না ।বলা বাহূল্য কিশোর বয়স থেকে জীবনানন্দ এই গ্রন্থরাজির মধ্যে নিমজ্জিত হতে পেরেছিলেন ।
তবে কুসুমকুমারীর কবিতায় ধর্ম ভাবনা সত্যের সাধনা,শুভবোধ,প্রকৃতি তথা নিসর্গ চেতনাই প্রধান হয়ে উঠেছে ।
জীবনানন্দের সাহিত্যপথ পৃথক হলেও তাঁর সমগ্র সাহিত্য রচনা মাতৃ প্রভাবের ছাপ রেখে যায় তাঁর নৈসর্গ প্রীতি ,বাংলার গ্রাম ক্ষেত পুকুর ও শ্যামলিমা ।
তাঁর এই কোমল মরমী মনটি মায়ের কাছেই পাওয়া ।
কুসুমকুমারী দাসের সম্পর্কে জীবনানন্দের মূল্যায়ন ,
".......প্রথম জীবনে মা কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন।যেমন ,"ছোট নদী দিন রাত বহে কুল কুল " অথবা "দাদার চিঠি","বিপাসার পর পারে হাসি মুখে রবি ওঠে "। একটি শান্ত ,অর্থঘন সুস্মিত ভোরের ়আলো ,শিশির লেগে আছে যেন এসব কবিতার শরীরে ।
সে --দেশ মায়েরই স্বকীয় ভাবনা__কল্পনার স্বকীয় দেশ ।কোনো "সময়" এসে এদের স্থানচ্যুত করতে পারবেনা ।''
".............
চারিদিকে উঁচু উঁচু উলুবন,ঘাসের বিছানা
অনেক সময় ধরে চুপ থেকে হেমন্তের জল প্রতিপন্ন হয়ে গেছে সে সময়ে নীলাকাশ বলে
সুদূরে নারীর কোলে তখন হাঁসের দলবল
.........(জীবনানন্দ দাশ)
বা
"কোথাও দেখিনি ,়আহা ,এমন বিজন ঘাস--প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে ----নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গাফড়িঙের নীড়,.........."(জীবনানন্দ দাশ)
রচনাগুলি পড়লে কুসুমকুমারীর সাহিত্যমূল্যায়নের অবিকল মিল পাওয়া যায় কবির রচনার সঙ্গে ।
      "সংসার--আহ্বান ভুলে
        প্রান্তরের শ্যামকোলে
তরুণ যোগিনী বালা ধেয়ানে মগন ।
          ভূমি রাশি ফোটা ফুল,
           ঊর্দ্ধে  হাসে তারাকুল,
চুম্বিছে শিশির-জল পুষ্পিত চরণ ।
......................(কুসুমকুমারী দাশ)
         The Exemplary Boy
___kusumkumari Das

When within our country will that boy be born
Who not by words but by deeds grows big and strong!
Smiling face,expansive chest,a mind thats full of fire;
"I must indeed become a man"__this,his fiirm desire .
................................(Translated by
            Clinton B.Seely


তথ্যসূত্র-
"কুসুমকুমারী ---সেই ছেলের মা,"
___সুমিতা চক্রবর্তী
"আমার মা"___জীবনানন্দ দাশ
"মানুষ জীবনানন্দ"__লাবণ্য দাশ
সূচরিতা দাশ__"জীবনানন্দ ও দাশ পরিবার"

জয়িতা ভট্টাচার্য

No comments:

Post a Comment