এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

আর্যতীর্থ




কবিতা (সাধারণ বিভাগ)




শমীগাছ

শমীগাছে মড়া বাঁধা আছে। পূতি গন্ধে ভরে আছে চারদিক।
এগোতে ভয় লাগে, যেন অযুত প্রেতাত্মার অশুচি ছোঁয়ায়
বাতাসও ভারী ওইখানে।
আশেপাশে যতদূর দেখা যায়, শমীগাছ শুধু।
বিকট গন্ধে প্রায়ই বমি উঠে আসে।
হাজার বছর ধরে চলে আসা ধর্মবিবাদ, গরলের মতো উঠে জ্বালায় গলার নলি।
গলাপচা মরে যাওয়া  বিভেদের দেহ আজও বিষসংস্কার হয়ে মগজ অসুস্থ করে দাঙ্গা বাঁধায়।
মড়াটার দিক থেকে দৃষ্টি সরায় লোকে, জাত ও ধর্মভেদে দুতরফে বিঁধে যায় দোষারোপ কাঁটা।
শমীগাছ, তাতে মড়া বাঁধা। দূর থেকে দেখা যায় গলে গলে পড়ে পচা মাংসপিন্ড,
পোকা লাগা আমরা ও ওরা বলা ধারণার কীট, সানন্দে কুরে কুরে খায় দাঙ্গায় পুড়ে যাওয়া মানুষের লাশ।
পোকা কিলবিল করে ‘ পিছড়ে’ তকমা পাওয়া আত্মহননকারী যুবকের লাশে,
গণধর্ষিতা কোনো আদিবাসী তরুণীর চিৎকারে নির্বিকার থাকা সমাজের মুখে পোকা থিকথিক করে।
হতাশায় পচে যাওয়া উচ্চবর্ণ কোনো বেকার যুবক বা যুবতী, মনহীন মৃতদেহ হয়ে ঝোলে শমীগাছ থেকে।
যে কজন জীবিত পড়ে আছে , এত মৃতদেহ দেখে তারা বেঁচে থাকা দোষ বলে ভাবে।
আসমুদ্রহিমাচল, আগুজরাটঅরুণাচল সারি সারি মড়া নিয়ে শুধু শমীগাছ।

কান পাতো, বিরাটরাজার গোরু চুরি করে কৌরব পালাচ্ছে আজ।
ওদের আইনের পরোয়া নেই, শাসকের ভীতি নেই,
বস্তুত অপরাজেয় ওরা।
হাজার হাজার কোটি অনায়াসে লুঠ করে ভরে সিন্দুক,  ওরা জানে আশেপাশে যত লোক আছে,
শমীগাছে ঝোলা মড়া দেখে সকলেই নাক টিপে ঘুরিয়েছে মুখ।

এবার সময় হলো , হে ধনঞ্জয়, পরিত্যাগ করো ওই বৃহন্নলার ছদ্মবেশ।
তুমি ছাড়া কেউ জানেনা, মড়াকে পেরিয়ে গেলে ওই শমীগাছে আছে তীক্ষ্ণ আয়ুধ, অনায়াসে কৌরব পরাভূত হবে।
শুধু তুমি পারো কৌরব বিনাশ করে ফিরিয়ে আনতে যত হৃতসম্পদ।
মাতৃভূমির ডাকে সাড়া কি দেবেনা তুমি ওহে অর্জুন! ওহে অর্জুন........



পাঁচটি খুনের গল্প

                            ( ১)

কিছু গাছ খুন হলো দিনেদুপুরে। চোখের সামনে ।
বিভৎস করাতের দাঁত, ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে গেল পাতা সহ ডাল।
শিকড় যেটুকু ছিলো, খুঁচিয়ে মারলো তাকে প্রবল শাবল।
আমরা নিরুত্তাপ, দুয়েকটা আহা ইস পাড়াতুতো খুনের গল্পে।
শুধু, তারপর থেকে আর কোকিল ডাকেনি এখানে।

                            (২)

গলিটা অপরিসর, বস্তুত গাড়ি ঢুকবে, পূর্বপুরুষেরা ভাবেনি কখনো।
যেমন ভাবেনি টালি টিন দরমার বেড়া, বড় হয়ে বহুতল হবে।
ভাঙাচোরা পলেস্তরাখসা এক দেড়তলা যে যেখানে ছিলো,
ভোল বদলিয়ে নিয়ে ঝক্কাস্ আধুনিক ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
জেঠিমা আর মেসোমশাইরা সময়ের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে লুটিয়ে পড়েছেন।

                             (৩)

চোদ্দ বছরে সিগারেট, সেটাও আবার স্কুলে। অশ্রুতপূর্ব নয়।
ধরা পড়ে শিক্ষকের ধমক ,স্কুল থেকে চিঠি। অভূতপূর্ব নয়।
পরের দিন মৃগীর খিঁচুনি। হাসপাতাল।মিডিয়ায় ইন্টারভিউ।
ব্রেকিং নিউজ।
কর্তৃপক্ষ  স্বীকার করেছেন শিক্ষকের দোষ। সাধারণ ঘটনা।
শুধু তালেগোলে এক শিক্ষক মারা গিয়ে চাকুরিজীবির জন্ম হলো। RIP.
                            (৪)

কলেজের উদ্দাম বন্ধুত্বে দারু থেকে পর্ন, সবকিছু চলে।
ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ থাকে না বিশেষ , কাম্যও নয় সেটা।
একসাথে পানশালা , সিগারেট ধোঁয়া আর আমিষ চুটকি।
মেয়েটা শুনতে পেলো তার বন্ধুরা আড়ালে তার দেহাংশ ব্যবচ্ছেদ করে।
স্বাধীন একটা পাখী ডানা মুড়ে ঝরে যায়, মরে দুম করে।

                              (৫)

হাসপাতালে রোগীর শেষ দিন।না না, ভাঙচুরের গল্প নয় এটা।
রোগী সুস্থ। বাড়ির লোক করজোরে ডাক্তারের সামনে। নিবেদন সহ।
টাকা কিছু শর্ট আছে। আপনার পয়সাটা পরে দিয়ে যাই?
চেক আপে তো আসবোই এক সপ্তাহে। বর মঞ্জুর হয়।
সপ্তাহ পার হয়ে বছর গিয়েছে। বিশ্বাস মরে গিয়ে চেম্বারে পড়ে আছে পোড়খাওয়া স্টেথোস্কোপ।




ঈশ্বর

সব যুদ্ধ জিতে গেলে তুমি বড় একা হয়ে যাবে,
ঈশ্বরের মতো।
চারদিক থেকে এসে হেরো হাত যত,
দেহি দেহি চিৎকারে তোমায় জ্বালাবে,
রূপ যশ বিদ্যা বা অর্থ, সব ভিক্ষালব্ধ ধন যেন,
আর তোমার কাজ সেই সব অকাতরে বিলানো,
অঞ্জলি করপুটে যেন আসে টুপ করে মুড়কি প্রসাদ,
না পেলেই হা হুতাশ, গালি, অপবাদ,
জিতেছো সব যুদ্ধে আর এইটুকু করতে পারো না?
তোমারও যে কিছু চাইবার থাকে, কারোর মাথায় নেই  তেমন ধারণা।
তাই, মানুষ থাকতে গেলে সব সংগ্রামে তুমি জিতো না কখনো,
মাঝে মাঝে হেরে যেও, তোমার জীবনীতে সে কাহিনীও এনো,
যেখানে হেরেছিলে গোহারান তুমি, লজ্জা বা ভয়ে ছেড়ে দিয়ে রণভূমি,
পালিয়ে গিয়েছিলে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো,
সাফল্য এসে গিয়ে এখন ফেলেছে ঢেকে সেই সব ক্ষত।
হেরে যাওয়া মুছে যদি  নিজেকে ভাবো অপ্রতিদ্বন্দী,
যদি  যাবতীয় ব্যর্থতাকে সাফল্য সিন্দুকে রাখো বন্দী,
অমোঘ নিয়তিটাও জেনে রাখো তবে,
ঈশ্বরের মতো একা হওয়াই তোমার ভবিতব্য হবে।




আই ই ডি

গ্লোবটা আরেকবার দেখলেন তিনি।
আলতো হাতে ঘোরালেন, থামলেন, আবার ঘোরালেন।
লাল দাগ দেওয়া বেশ কিছু জায়গায়।
সিরিয়া, ইরাক, নাইজেরিয়া, কঙ্গো, সারাজেভো, বসনিয়া...
যেখানে মানুষের মনে আই ই ডি বসানো গেছে,
ধর্ম ইত্যাদির পলতে ধরালেই .. বুম!!
তিনি ইবলিশ, শয়তান, ডেভিল। যে নামেই ডাকুক দুনিয়া,
ভগবানের সাথে তাঁর চিরশত্রুতা।
মগজে আই ই ডি তার অত্যাধুনিক আবিষ্কার,
আগে ছোটো ছোটো হতো।
লোকে আত্মহত্যা করতো, বড়জোর প্রেমিকা বা পড়শীকে খুন করতো,
কিংবা ধর্ম বা জাতির নামে পাগল হতো।
তাবত সৃষ্টির তাতে কিচ্ছু যায় আসতো না।খবর হয়তো হতো কোনো মহল্লায় এক দুটো দিন।
অবশ্য সুযোগ বুঝে বিশেষ কোনো মগজ খুঁজে গুঁজে দিয়েছেন তাঁর বিস্ফোরক
হোসেইনহন্তারক শিম্রে ইবনে জিলজুশান, বুদ্ধবিরোধী অজাতশত্রু থেকে রোম সম্রাট ডায়োক্লেশিয়ান,
সকলের মগজে বিষ ভরে হত্যা করিয়েছেন চিরশত্রু ঈশ্বরের অজস্র উপাসককে।
কিন্তু ঠ্যাঁটা সভ্যতা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঠিক উঠে দাঁড়িয়েছে।
দুর্দান্ত সুযোগ এসেছিলো কয়েকবার , ঈশ্বরের এই অসহ্য সৃষ্টি শেষ করার।
ইবলিস পেয়েছিলেন চেঙ্গিসকে, তৈমুরলংকে, এমনকি কিছুদিনের জন্য রাজচক্রবর্তী অশোককেও।
মিনিটে পাঁচশো গুলির মহাবন্দুক আবিষ্কার করিয়ে পুতুলের মতো নাচিয়েছেন হিটলার থেকে পোল পট, গণহত্যাকারী তাবত নেতাদের।
কিন্তু কোথাও ফল্গুধারার মতো মানবতা ঠিক বয়ে চলেছে,
কোথাও কেউ বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, মানুষ অমৃতের সন্তান,
অন্ধকার নয়, আলোই তার চিরস্থায়ী গন্তব্য।

অবশেষে , এই একবিংশ শতকে এসে( উফ, এই তারিখটাও সেই ঈশ্বরের পুত্রকেই মনে করায়, অসহ্য!)
শয়তানের আই ই ডি পূর্ণরূপ পেয়েছে।
এখন মানুষের মগজে বসালে সে দিব্যি উড়িয়ে দেয় স্কুলের বাচ্চাদের আলটপকা মেশিনগানে,
ধর্মের নামে করতে পারে অজস্র গণধর্ষণ, উজার করে দিতে পারে গ্রাম কে গ্রাম জাতিশুদ্ধির নামে,
এবং কি আনন্দের কথা, এরা সব সাধারণ লোক, ঘাতক হওয়ার আগে কেউ চাষী, কেউ শ্রমজীবী,
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ড্রাইভার ধোপা বা ট্রাকের খালাসী,
স্বভাবত, এহেন অভূতপূর্ব সাফল্যে ইবলিস খুশী।

শয়তান থামলেন।দেখলেন।ভারতের পূর্বদিকে এক প্রদেশ রঙিন আবিরে মেতে উঠেছে উৎসবে,
গাছেরা সেজেছে সূর্যোদয়ের আকাশের মতো টকটকে লাল রঙে,
রাস্তার ধারে রাধাচূড়া আর পলাশ বিছিয়েছে লালহলুদের মখমলি চাদর।
নাহ! এ সহ্য করা যায়না, এই সামূহিক ধ্বংসের মধ্যেও লোকের এই বসন্ত আগমনীর আদিখ্যেতা।
কিছু একটা করতেই হবে! শয়তান ঘোরালেন তার যন্ত্র, ঝাঁকে ঝাঁকে আই ই ডি ছুটলো অজস্র মগজের দিকে।
কিন্তু এ কি! আজ তাঁর বিষকল কাজই করলো না , এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কারণ খুঁজে পেলেন ইবলিস,
তাঁর মুখ থেকে বেরোলো এক ভীষণ অপার্থিব আর্তনাদ....
‘ তোমার সর্বনাশ হোক ঈশ্বর, সর্বনাশ হোক তোমারও, রবীন্দ্রনাথ!’


আর্যতীর্থ

1 comment:

  1. এসব সাধারণ সহজ কথার এক অর্থপূর্ণ দরদ যা মনে রেশ রেখে যায় বহুক্ষণ !

    ReplyDelete