এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

অমিতাভ প্রহরাজ



বেবীটক্




ডিসিসান ফ্যাটিগ বা সিদ্ধান্তক্লান্তি : লেখার মানুষের ক্যানসার


এই নোটসটি আমার গতো প্রোফাইলের খুব এ্যাম্বিশাস কাজ ছিলো। ভাগ্যিস অপারবাংলায় এটা প্রকাশিত হয়েছিলো, তাই সেখান থেকে রিভাইভ করলাম। অপারবাংলার লিংকটা পরে দিচ্ছি, কিছু ফরম্যাটিং এর গণ্ডগোল আছে বলে। আর অপারবাংলায় এখন আমার উপন্যাসটা বেরোচ্ছে। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব এই সপ্তাহেই আসছে অপারবাংলায়। আগেই আসতো, ভাইরাল ফিভারে একটু কাবু হয়ে যাওয়ায় দেরী হলো। এই লেখাটি আগে যারা পড়েছিলেন, জানেন এটির আরেকটি পর্ব ছিলো, কন্টিনুয়েশান ছিলো। সেগুলি হারিয়ে গেছে আগের প্রোফাইলের সাথে। এটুকুই উদ্ধার হয়েছে

(গত চার বছর আমি সোশাল নেটওয়ার্কিং এর ভাষা বা থার্ড ফর্ম অফ ল্যাংগুয়েজ বা লেখ্য কথ্য ভাষা, যাকে আমি ডিনোট করেছি “মামুলিভাষা” বলে, তা নিয়ে এক বিস্তীর্ণ গবেষণা চালাচ্ছিলাম। সাইকোলিংগুইস্টিক্সের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে। তা করতে গিয়ে, এবং নানান কেস স্টাডি ঘেঁটে, দেখে, এক ভয়াবহ অবস্থার ছবি পাই। রীতিমতো শিউরে উঠি তা দেখে। কি ভয়ংকর এক ব্যাধি বা মহামারীর সম্মুখীন লেখা। এবং তখনই ঠিক করি যে এগুলো নিয়ে লেখা অতীব প্রয়োজন। সাংঘাতিক প্রয়োজন। আমার সেই লেখাগুলির প্রথম লেখাটি এটি। আপনি যদি লেখার মানুষ হন, লেখার সম্পর্কযুক্ত যে কেউ হোন। প্লিজ পড়ুন, কারন এটি কোনো দর্শনচিন্তা বা সৃজনী ভাবনা নয়। এ এক রিয়াল বিপদ। ভয়ংকর।)

সৃজনশীলের ক্লান্তি যেকোনো ক্রিয়েটিভ মানুষের এক বড় সমস্যা। এ চিরকালীন। নইলে ব্যাসদেব গণেশের গপ্পোটা জন্মায় না মহাভারত নিয়ে। কিন্তু গত এক দশকে (আমি বাংলা লেখার সাপেক্ষে সময়টা ধরছি) এই ক্রিয়েটিভ ফ্যাটিগ একটা মহামারীর আকার আমাদের অজান্তে। খুব সাধারণ একটা বিষয় আমরা লক্ষ্য করতে পারি দশ বছর আগে একটা লেখা বা একটা ভালো কবিতা আমাদের সঙ্গে যতোটা সময় ধরে থাকতো, এখন তার জীবদ্দশা একের একশো ভাগ হয়ে গেছে। সাধারণ ভাবে মাথায় আসে কারন, একটু কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগা মধ্য বাঙালীর ভাষায় বলি "এই ফেসবুকে গান্ডেপিন্ডে কবিতা লিখছে লোকজন। সব্বাই লেখক, বমির মতো ফাঁকতাল পেলেই উগরে দিচ্ছে কবিতা। ঘেন্না ধরে গেল ছ্যা ছ্যা ছ্যা।"

কিন্তু বিষয়টা এত সহজ বা সরলীকরন যোগ্য নয়। গত দশ বছরে সোশাল নেটওয়ার্কিং যুগ আসার পর একটা নতুন ক্লান্তি ঢুকেছে মানুষের জীবনে। অজান্তেই। বিশেষতঃ ক্রিয়েটিভ মানুষের জীবনে। যেকোনো ক্রিয়েটিভিটির দুটো দিক আছে। একটা ইনফ্লো আরেকটা আউটফ্লো। আমি লেখাম্যান, লেখার দিক দিয়েই বলি। ইনফ্লো হচ্ছে লেখার উপকরণ কতো ঢুকছে ভেতরে, মানে সারা দিনের দেখা, পড়া, ঘটনা ইত্যাদি যা লেখান্তরিত করার যোগ্য। আর আউটফ্লো হচ্ছে লেখা। চালু ধারণা ছিলো যে প্রচুর লিখলে লেখার ক্লান্তি আসে। বড়রা বলতেন, অতো না লিখে একটু পড়াশুনো করো না ভাই। কিন্তু গত দশ বছরের রিসার্চ দেখায় যে লেখার ক্লান্তি অতিরিক্ত আউটফ্লো থেকে নয়, মাত্রাতিরিক্ত ইনফ্লো থেকে জন্মাচ্ছে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বয়সে ছোটো যে সমস্ত লেখার মানুষদের সাথে যোগাযোগে থাকি এবং প্রায়শঃই শুনে থাকি এই সমস্যা “লিখতে ভাল্লাগছে না”, “লেখা হচ্ছে না”, “লেখা আসছে না” “ল্যাদ লাগছে লিখতে”, খুব খুঁটিয়ে ঘেঁটে দেখেছি দশটির মধ্যে দশটি ক্ষেত্রেই এর কারন এই অত্যধিক ইনফ্লো, ওদের অজান্তেই। হ্যাঁ, অজান্তে। পঞ্চু বলবে “না বেবীদা, এটা বালের কথা, আমি মোটেই অতো কবিতা টবিতা পড়িনা, বা লেখা পড়ি না”। আমি বলবো “বৎস পঞ্চু, এটা ওই লেখা পড়া থেকে আসে না। এটা আসে ওই সিদ্ধান্তে পড়া থেকে।” “এ্যাঁ?” বুঝিয়ে বলি বিষয়টা কি মারাত্মক।

যেকোনো লেখা একটি সিদ্ধান্ত অমনিবাস। আমাকে প্রত্যেক মুহূর্তে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হয়। যেমন “কি লিখবো শব্দটা? সিদ্ধান্ত না ডিসিসান? সিদ্ধান্তে আসতে হয় না ডিসিসান নিতে হয়? ওকে, সিদ্ধান্তে আসতে হয়”, এই একটা সিদ্ধান্ত। এরকম অপশান কবিতার ক্ষেত্রে প্রতি শব্দে, গদ্যের ক্ষেত্রে প্রতি এক্সপ্রেশান বা বাক্যাংশে, চালাতেই থাকে লেখার মানুষ। ফলে একটা ৩০ শব্দের কবিতা মানে মিনিমাম তিরিশ খানা সিদ্ধান্ত বা ফাইনাল কল, এরপর শুরু শেষ, নামকরণ, কাটাকুটি, ডট ডট না দাঁড়ি ইত্যাদি তো আছেই। মিনিমাম তিরিশ। সুতরাং যেকোনো লেখা মানেই এক সিদ্ধান্ত পর্বত বেয়ে সামিট করা। এবার এর সাথে জীবনমশাইকে যোগ করুন, রোজকার। সকালে বাজারে গিয়ে চন্দ্রমুখী নেবো না জ্যোতি, কতো দাম? ১২ টাকা। ১১ বলবো না ১০। ট্যাংরা না পাবদা। সকালে বালিকাকে কি একটি মেসেজ পাঠাবো না পাঠাবো না। বেরোতে দেরী, এই বাসটায় উঠবো না একটা ছেড়ে ফাঁকাটাতে উঠবো। দিন চলে সিদ্ধান্ত নিতে নিতে। তার মধ্যে যতোটা যন্ত্রত্ব নিজের মধ্যে ঢোকাতে পারে মানুষ বয়সের সাথে সাথে। ইমোশানাল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্র তো ভূরি ভূরি। ঘোর ব্রেক আপ পিরিয়ড চলছে, একবার মনে হচ্ছে মেয়েটি বুঝলো না, একবার মনে হচ্ছে আমি কি খারাপ।

সংসারী হলে, সংসার সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নানারকম, বৌ এর ঠোকা, দেব নাকি বৌ কে পালটা একটা, না চুপ করে থাকবো কি দরকার অশান্তি বাড়িয়ে। মহা মহা সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রগুলি তো বরকরার। একটা হাউসিং লোন নিতে হবে, নতুন মোবাইল কিনতে হবে, ব্লা ব্লা ব্লা। সাইকোলজি বলে একটা ব্রেন গড়ে দৈনিক ৫০০ টি সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এই ডিসিসান মেকিং এ যেটা কাজ করে সেটি হলো উইল পাওয়ার। মানে এভাবে বলা যায় উইল পাওয়ার যদি মাসল হয়, সিদ্ধান্তগ্রহন হচ্ছে মাসলের ওয়ার্ক আউট। এতদুর অবধি সব ঠিক আছে। শুধু সময়ের সাথে ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্র যতো বিস্তীর্ণ হয়েছে ততো বেশী সিদ্ধান্তের চাপ এসে পড়েছে মাথায়। হার্ডকোর পারিবারিক বা সামাজিক কাঠামোতে অতি পচা শব্দ “মূল্যবোধ” বা ভ্যালুজ আমাদের পরোক্ষভাবে এই সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষেত্রগুলি কমিয়ে আনে। কিন্তু শুধুমাত্র সেটার জন্য স্বাধীনতা অস্বীকার করে বদ্ধ স্ট্রাকচারে থেকে যাওয়ার কোনো কারনই তো হয় না? নিশ্চয়ই, একমত।

কিন্তু গত দশ বছরে কি ঘটেছে। যতো সময় কাটাচ্ছি আমি ফেসবুকে, নেটে। আমার অজান্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষেত্র। রিয়াল ভার্চুয়াল তফাত মাথায় এই ২০১৬ তে দাঁড়িয়ে কাজ করে না, করা উচিতও নয়। তাই এই ফেসবুক পৃথিবীতে ঢোকা মাত্র আমি এক অল্টারনেটিভ সমাজব্যবস্থায় ঢুকছি যার একমাত্র কাঠামো ব্যক্তিস্বাধীনতা (প্লিজ, প্লিজ এটা ফেসবুক বিরোধী লেখা নয়, ওরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে পড়বেন না)। কিন্তু যেহেতু সবাই সমান, এই অতুলনীয় সাম্যবাদী সমাজ আমার ঘাড়ে এক পর্বত চাপিয়ে দিচ্ছে। একটা স্ট্যাটাস দিচ্ছি, লেখা বাদ দিয়ে প্রায় খান দশেক মেজর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বক্তব্য, প্রকাশ ইত্যাদি নিয়ে। ট্যাগ করছি, যতজন ততগুলো সিদ্ধান্তগ্রহণ। প্রত্যেকটা কমেন্ট পড়ছি, এক একটা মেজর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, এর সাথে সহমত না সহমত নয় (মেজর আর মাইনর সিদ্ধান্তের পার্থক্য হচ্ছে এ্যানালিসিস এর পরিমাণ। যেখানে অনেক কিছু মাথায় রেখে এ্যানালিসিস করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সেগুলো মেজর সিদ্ধান্ত। আমি অমুককে ভালোবাসি না ভালোবাসিনা), একেকটা লাইক একেকটা সিদ্ধান্ত। পড়ে একেকটা লাইক না দেওয়া, এক একটা সিদ্ধান্ত। অন্যের স্ট্যাটাস পড়ছি। লেখা পড়ছি। তর্কে জড়াচ্ছি। এর সাথে জুড়ে নিন পার্সোনাল চ্যাট। একজন লেখার মানুষের ক্ষেত্রে এটা বহু বহু বহুগুণ ভাইট্যাল কারন, এখানে সমস্ত কিছু লিখে করতে হয়। ওই থার্ড ফর্ম অফ ল্যাংগুয়েজ বা লেখ্য কথ্য ভাষা বা আমি একটি শব্দ ব্যবহার করি “মামুলিভাষা”, ওই মামুলিভাষায় লিখতে হলেও লিখতে হয়। কথ্য ভাষার সুবিধে হচ্ছে কি, কথা বলার সময় বডি ল্যাংগুয়েজ, কন্ঠস্বরের ওঠানামা ইত্যাদি এইগুলো অনেকটা মাসল মেমরি থেকে চলে আসে বলে আবেগ হ্যান্ডলিং এ অতো সিদ্ধান্তের চাপ পড়ে না। প্লাস মুখে কথা বলার সময় ওয়ান ইজ টু ওয়ান কম্যুনিকেশান হয়। আমি কনসেনট্রেট করতে একজনের ওপরে, এবং সম্পর্ক অনুযায়ী নিজেকে ইমপালস এর হাতে ছেড়ে দিতে পারি। ফলে প্রতি পদক্ষেপে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিশ্রম অনেকটা কমিয়ে দেয় আবেগ। কিন্তু এই মামুলিভাষায়, ধরে নিন একটা ঝগড়া হচ্ছে, সেখানে যার সাথে তর্কবিতর্ক হচ্ছে শুধু সে নয়, বাকি পুরো সমাজ তার সাথে ইনভল্ভড। এটা একাধারে ওয়ান ইজ টু ওয়ান, ওয়ান ইজ টু মেনি। এ এক বিরাট চাপ ফেলে মাথায়। এ্যানালজি দিয়ে বলতে পারি, ধরে নিন প্রেমিকার সাথে ঘরের সঙ্গোপনে ঝগড়া হচ্ছে, আর মাঝরাস্তায় ঝগড়া হচ্ছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মাথায় এক্সট্রা বিপুল চাপ থাকে “সিন ক্রিয়েট” জাতীয় ঘটনা সম্বন্ধীয়, ঠিক সেইরকম। ফলে মামুলিভাষায় তর্ক বিতর্ক করলেও মাথার ওপর একটা চাপ কনস্ট্যান্ট থেকে যায়। এ্যামিগডালা (amygdala) অংশটি ব্রেনের সর্বদা সক্রিয় রাখতে হয় যা ইমপালস কন্ট্রোল করে।
যেকোনো লেখার মানুষ যেহেতু যেকোনোরকম পাঠবস্তুকে শ্রবণবস্তুর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে থাকে স্বভাববশতঃ, ফলে এই অবস্থায় সাধারন মানুষের ডিসিসান স্পেক্ট্রাম যতোটা বাড়ে, লেখার মানুষদের ক্ষেত্রে বহুগুণ বেড়ে যায় অজান্তে। হোক না কমেন্ট বা স্ট্যাটাস, পাঠবস্তু তো। পড়ে, এ্যানালাইজ করে, তার অর্থ নিষ্কাশন করতে হয়। এগুলোর সাথে যোগ করুন নেট সার্ফিং এর অন্যান্য নানা ক্ষেত্র। ফ্লিপকার্টে এমনি চোখ বোলানো, প্রতিটি জিনিসের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় এক একটা এ্যানালিসিস ও সিদ্ধান্ত ক্ষেত্র পেরিয়ে যায়। সাউন্ডক্লাউডে গিয়ে কোন কোন গান ডাউনলোড করবো সেখানেও। এমন কি, খুব পাতি জিনিস, ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছেন মোবাইলে। ফাংশানাল এম আর আই তে দেখা যায় প্রত্যেকটা সোয়াইপ করার সময় ব্রেনের এ্যামিগডালা অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে, অর্থাৎ এক একটা সিদ্ধান্ত। আর এজ অফ এম্পায়ারস ইত্যাদির মতো স্ট্র্যাটেজি গেম ইত্যাদি তো ছেড়েই দিন। এই বিপুল অতিকায় সিদ্ধান্ত ক্ষেত্র একজন লেখার মানুষ নিজের মাথায় চাপিয়ে নেওয়াকে একটা দারুণ এ্যানালজি দিয়ে বলা যায়। অলিম্পিয়ান এ্যাথলীটের ধূমপান!!
এমত অলিখনে কি ঘটে-

লেখার মানুষের তো দুই ভাগে ভাগ সময়। লিখন আর অলিখন। আউটফ্লো আর ইনফ্লো। এই ইনফ্লো বা অলিখন যদি এই মাত্রায় বেড়ে যায় তো দুটো জিনিস ঘটে যার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কমবেশী কখনো না কখনো ফেস করেইছি।
এক নম্বর, এ্যানালিসিস প্যারালিসিস। এতে ক্রমাগত এ্যানালিসিস করার জন্য উইল পাওয়ারকে ব্যবহার করতে করতে ফ্যাটিগ এমন স্তরে পৌঁছোয়, যে একটা সময়ে চাইলেও ব্রেন এ্যানালিসিস করতে পারেনা। এ্যামিগডালা কমপ্লিট অফ হয়ে যায়। ইমপালস কন্ট্রোল হয় না। এবং ব্রেনের পুটামেন (putamen) স্পেশালি নিউক্লিয়াস এ্যাকাম্বেন্স (neucleus accumbens) অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কঠিন টার্ম বাদ দিয়ে বলা যায়, ব্রেন তখন তার নিজস্ব কেমিক্যাল ট্রিগার ডোপামাইন এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। এই সম্পূর্ন কেমিক্যাল ডিপেনডেন্সি ব্রেনের এক বিশাল ক্ষতি করে। কতোটা? আঁৎকে উঠবেন না, পার্কিনসনস ডিজিজ জাতীয় নিউরাল ডিসঅর্ডার এর সম্ভাবনা প্রচণ্ড বেড়ে যায় যখন অত্যধিক ডোপামাইন নির্ভর হয়ে পড়ে ব্রেণ। (একটা ছোট্ট সাইড তথ্য, যেকোনো কেমিক্যাল নেশা, কোকেন টু কোডিন, কিছুই না এই ডোপামাইন সিক্রিশান বাড়িয়ে দেয়)। ফলে একজন লেখার মানুষ ধরুন সকাল থেকে ফেসবুকে আছেন, খুব এ্যাক্টিভলি, রাত্রে একটা সময়ে সত্যিকারের নেশা নেশা টাইপ অবস্থা চলে আসে। ওটাই এ্যানালিসিস প্যারালিসিস।

দুই নম্বর, হলো ইগো ডিপ্লিশান। টার্ম বা জার্গনে না গিয়ে সহজভাবে বলি। এই যে মাইনর মেজর সিদ্ধান্ত ফারাক করার ক্ষমতা মাথার, আমি তাকে ভালোবাসি না ভালোবাসিনা আর আমি পঞ্চুর কমেন্টের প্রত্যুত্তর দেব কি দেব না, দুটোই এক স্তরে নেমে আসে। এ এক ভয়ংকর ঘটনা যা অজান্তে ঘটে। জীবনে ঘটনাদের গুরুত্বভাগ, যা মাথার একটা প্রচণ্ড জরুরী ফাংশানিং সেটা বন্ধ হয়ে যায়। আমি প্র্যাক্টিটাল টেস্ট করে বহুবার দেখেছি। একটি স্ট্যাটাস বা মন্তব্য নিয়ে উত্তেজিত হয়ে একাধিক দিন কাটিয়ে ফেলছে একজন মানুষ, এবং সেটা তার দৈনন্দিন জীবনের ডাক্তার দেখবো কি দেখাবো না জাতীয় গুরুতর সিদ্ধান্তের থেকেও গুরুতর হয়ে উঠছে। একেই বলে ইগো ডিপ্লিশান। এটা এক মহামারীর আকারে দেখা যায় লেখার মানুষদের মধ্যে। ইগো ডিপ্লিশান হলে কি হয়, ব্রেনের লং টার্ম শর্ট টার্ম গুলিয়ে যায়। যেকোনো সিদ্ধান্ত থেকে আমরা একটা ফলাফলের দিকে তাকাই। সেটা লং টার্ম গোল হতে পারে, শর্ট টার্ম গোল হতে পারে। আমি ফ্ল্যাট কিনবো কি কিনবো না, এটা লং টার্ম। আমি চন্দ্রমূখী কিনবো না জ্যোতি কিনবো এটা শর্ট টার্ম। এবার এমন অবস্থায় এসে গুলিয়ে গেলে দুটো সম্ভাবনা থাকে। এক আমি ফ্ল্যাট কেনার গুরুত্ব সহকারে যদি আলু কিনি, তাতে হাস্যকর হয়ে উঠবো বা অসংলগ্ন আচরণ প্রকাশ পাবে। কিন্তু আমি যদি আলু কেনার গুরুত্ব দিয়ে ফ্ল্যাট কিনি বা ভালবাসা নির্ধারণ করি, তখন যা ঘটবে তা মারাত্মক, সেটা ক্ষতি। এবং এই ক্ষতি লেখাতে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। তাই হয়েছে চতুর্দিকে। যে কথাটা শুরু করেছিলাম, আগে একটা কবিতার সাথে এক বছর কাটানো যেত, এখন এক ঘন্টাও কাটে না। তার কারন ইগো ডিপ্লিশান হতে হতে আমরা শর্ট এ্যাটেনশান স্প্যানে ভুগি। সব্বাই। শর্ট এ্যাটেনশান স্প্যান মানে, হোর্ডিং এও লাইন লেখা থাকে, কবিতাতেও লাইন লেখা থাকে। বিজ্ঞাপনের লোক হিসেবে জানি, মানুষ একটা হোর্ডিং এর পেছনে এ্যাটেনশান স্প্যান দেয় ৩-৪ সেকেন্ড। তাই কপি লেখার সময় আমাদের মাথায় রাখতে হতো এমন লাইন লিখতে হবে হোর্ডিং এ যেটা ৩-৪ সেকেন্ডে রেজিস্টার করে। কবিতায় এক লাইনের পেছনে কতো দেয় সেটা নিশ্চয় বলার দরকার নেই। মজা হচ্ছে, এক্ষুনি আপনি যদি বলেন ওটা হোর্ডিং বলেই ৩-৪ সেকেন্ড দি, আমি বলবো মহাশয়, এ আপনার ভুল ধারণা। হোর্ডিং এ ৩-৪ সেকেন্ড সময় এ্যাটেনশান স্প্যান দেওয়ার কারন, আমরা হোর্ডিং বেশীরভাগ সময় চলন্ত অবস্থায় দেখি, বাস থেকে ইত্যাদি। এটা আপনার নিজের স্থির করা সময় নয়। মাথা হ্যাবিচুয়েটেড হয়ে যায় ওরকমভাবে। একইরকম এই বিপুল সিদ্ধান্ত ক্ষেত্র মাথায় চাপিয়ে নিলে, এমন ডিসিসান ফ্যাটিগ জন্মায় যে ফেসবুকে পড়া কোনো কবিতাকে ওই চলন্ত বাস থেকে দেখা হোর্ডিং এর মতো এ্যাটেনশান স্প্যান নিয়ে চলে আসে, অজান্তেই। তাই এক ঘন্টাও সঙ্গে থাকে না কবিতা।
শেষ কিছু কথা-

বারবার বলেছি, এটা ফেসবুক বিরোধী লেখা নয়, বা আমি এ্যান্টি ফেসবুক মানুষ নই। এই লেখার উদ্দেশ্য এই লেখ্য কথ্য ভাষার দুনিয়া, বা মামুলিভাষার দুনিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। যতো তাড়াতাড়ি এবং যতো বেশী আমরা সচেতন না হবো ততো এই ব্যাধি মারণ ব্যাধির মতো লেখার মানুষদের লেখার গভীরতা কেড়ে নেবে, ব্যাপ্তি কেড়ে নেবে। পেঙ্গুইন পেপারব্যাক থ্রিলার চালু হয়েছিলো ট্রেন যাত্রায় সময় কাটানোর জন্য। এই সচেতনতা, ডিসিসান ফ্যাটিগ নিয়ে চিন্তাভাবনা না বাড়ালে, ক্লাসিক তো বহুদূর, অচিরেই এমন সময় আসবে যখন লেখা আর সময় কাটানো সমার্থক হয়ে যাবে।

এর প্রতিকার, নিরাময় ইত্যাদি নিয়ে বহু গবেষণা শুরু হয়েছে, স্ট্যানফোর্ডে, প্রিন্সটনে। আমি নিজের মতো করেও এই সমস্যাটির হাল হকিকত জানার চেষ্টা করছি গতো চার বছর ধরে। সেসব নিয়ে পরে আসবো। একটা ছোটো প্র্যাকটিসের কথা বলতে পারি যেটা যেকেউ শুরু করতে পারেন, এবং কাজে দেবে। সেটা হলো ডিসিসান পোস্টমর্টেম। আমরা সাধারণতঃ ইম্পালসিভ সিদ্ধান্ত নিলে সিদ্ধান্ত থেকে পালাই। যেমন খুব খারাপ ব্রেক আপ ঝগড়া মনে করতে চাই না। এটাকে কমপ্লিট উলটে দেওয়া যায় যদি। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, মানে ইম্পালসিভ, উত্তেজিত সিদ্ধান্ত সেইসময়ের বেশ কিছু পরে ফিরে দেখুন। ময়না তদন্ত করুন যে সত্যিই প্রয়োজন ছিল না ছিলনা এই উত্তেজিত কথোপকথন বা তর্কাতর্কি বা স্ট্যাটাসের বা কমেন্টের, যা হোক না কেন। খুঁটিয়ে পোস্ট মর্টেম করুন প্রতিটি মেজর ইম্পালসের। যদি মনে হয় সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, নিজের কাছে স্বীকার করুন, ঠিক হলেও নিজেকে এ্যাসিওর করুন। এটা দারুণ কাজে দেয়।

আর দ্বিতীয় যেটা কাজে দেয় সেটা তো চিরকালীন। বেশী লেখা, আরো বেশী লেখা, আরো আরো বেশী লেখা, আরো আরো আরো বেশি লেখা। এটার সহজ উপায়, নিজের লেখার ভাষা আর ফেসবুক বা লেখ্য কথ্য ভাষাকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে দিন। মামুলিভাষায় লেখার চর্চা করুন প্রচুর। ফেসবুকে ঢুকলেই ভাষা মোড চেঞ্জ করে নিলাম, আর লিখতে বসলে লেখা মোড অন করে নিলাম, এ এক ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর অভ্যেস। লেখা ধ্বংস করে দেবে। মামুলিভাষাও একটা লেখার ভাষা। আপনিই লেখেন সেটা। ওটাও সেই আমি নিজেকে তৈরী করা। আপনার লেখার ভাষা যদি অন্যের থেকে স্বতন্ত্র হয়, তবে আপনার মামুলিভাষা কেন হবে না? এই সচেতন চর্চাটা থাকলে ডিসিসান ফ্যাটিগ বা এক্সেসিভ কনজাম্পশান অফ থিংকিং টা লেখার আউটফ্লো দিয়ে ব্যালেন্স হয়ে যাবে। উন্মাদ ভালো, উন্মাদনা নয়। উন্মত্ত হওয়া যাক, প্রতিটি উন্মাদনার ক্ষেত্রে, লেখায় উন্মত্ত।

পুনশ্চ- এটা পড়ে কেউ যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোন যে “নাহ্‌। ফেসবুক আর নয়”, বা “ফেসবুক কমিয়ে দেবো” বা “ফেসবুক ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর”, তাহলে সেটা হবে ডিসিসান ফ্যাটিগ বা সিদ্ধান্তক্লান্তির এক আদর্শ উদাহরণ। ফেসবুক শত্রু নয়, ফেসবুকের লেখা লেখার শত্রু নয়। কারন এটা একটা নিড এখন, যাই ফেসবুক, তাই হোয়াটস্যাপ, তাই মোবাইল, এই পার্সপেক্টিভে। সুতরাং শত্রু হচ্ছে ফেসবুক ডীলিংস এবং ইন্ট্যারাকশান নিয়ে সচেতনতার অভাব। মামুলিভাষার গুরুত্ব বোঝার অভাব হচ্ছে শত্রু। যন্ত্রসভ্যতা আসার সময়ও একই মাপের ক্রাইসিসে পড়েছিলো মানুষ, কাটিয়ে উঠেছে যন্ত্রের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে, যন্ত্র আর শ্রমের সম্বন্ধ ও সম্পর্ক খুঁজে বের করে। একইরকম ফেসবুকের সাথে শ্রমের সম্পর্ক খুঁজে বের করাটাই আসল পরশপাথর।

ফলো আপ-
এটার একটি ফলো আপ লেখার ছিলো। উর্মি (না উর্ম্মি?) আরোহী ভট্টাচার্যের একটি কমেন্ট ও তার কন্টিনুয়েশান হিসেবে লিখলাম।
Urmi Aarohi Bhattacharya- Chaaper byapar...sotyi... tobe amr modhye klanti ekhono na asleo chat krte akdom ichche hoy na...or cheye phn a ktha bola anek valo
অমিতাভ প্রহরাজ-  একদম... তবে এই ক্লান্তি যেহেতু শারীরিক বা মানসিক ক্লান্তি নয়... এটা অনেক গভীরে... উইল পাওয়ারের ক্লান্তি... তাই এটা বাহ্যিকভাবে কেউ বুঝতে পারে না... এবং তাই সকলে এফেক্টেড এতে... এটা বোঝা যায় কি করে বলতো... আসতে আসতে জীবনে মেজর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় যে অতুল্য কনফিডেন্স কাজ করে মানুষের, কাউকে প্রোপোজ করার সময়, সম্পর্ক ভাঙার সময়, চাকরি জয়েন করার সময়, বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার সময়, সেই জায়গাটা ক্ষয়ে যায়... এবং আস্তে আস্তে আমাদের সিদ্ধান্তের কোয়ালিটি পড়তে থাকে, এবং জীবন দুলন্ত নৌকোর মতো হয়ে যায়... টপসি টার্ভি এফেক্ট... যা আমরা সবাই ফিল করি আজকাল... আজ দারুণ আনন্দ তো কাল দারুণ ডিপ্রেশান... এই তুমুল ওঠানামা মাথা নেওয়ার মতো একটা বয়স অবধি থাকে... তারপর সেটা ক্ষয় হতে থাকে, এবং মাঝবয়সে এসে মানসিক রোগের চেয়ে স্নায়ুরোগের সম্ভাবনা প্রচুর বেড়ে যায়... আমেরিকাতে এই কারনে আজ ৩০-৪০ বছর বয়স্ক প্রায় ৬০%, সংখ্যাটা ভুল নয়, ৬০% ব্যাসাল নিউরাল গ্যাংগ্লিয়া সমস্যায় আক্রান্ত, অর্থাৎ যেটা হচ্ছে পার্কিনসনস বা আরো পরে এ্যালঝেইমার্স এর অঙ্কুর বলা যায়... তাই সিচুয়েশান টা এত ভয়াবহ... আর আরেকটা জিনিস অনেকেই ভুল করছেন... আমি কিন্তু শুধু তর্কাতর্কি বা ঝগড়ার কথা বলিনি... তাতে এক্সট্রা চাপ পড়ে ঠিকই... কিন্তু তা না হলেও, এমনি সিম্পল কমেন্ট, বা স্ট্যাটাস বা লাইক দিতে গেলেও মাথাকে এক্সট্রা এ্যানালিসিস প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়...... বিশেষতঃ লেখার মানুষ যারা, আমার মেন কনসার্ন তাদের দিয়ে...
কারন কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে এর সাথে যুদ্ধ করার নানারকম উপায় ও কার্যক্রম রয়েছে... প্লাস সবচেয়ে সুবিধে সেখানে টিম বা গ্রুপ আছে... ফলে টিমওয়ার্ক বা গ্রুপওয়ার্ক দিয়ে এটাকে ফাইট করা হয়... তাতেও অবস্থা এত ভয়াবহ যে এর যুদ্ধ করার টেকনিক আবিষ্কারের জন্য স্টিভ জোবস থেকে বিল গেটস থেকে ওবামা অবধি মাথা ঘামাতে বাধ্য হয়েছে... তা ওনারা বড় মানুষ... কর্পোরেট পৃথিবীও বড়ো বড়ো মানুষের... এই সিদ্ধান্তের গুণগত মান পড়ে যায় বড় উদাহরণ রিসেন্ট খবরে আসা মৈনাক সরকার ও গুলিচালনার ঘটনা... সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কতোটা এ্যানালিসিস প্যারালিসিস ঘটলে একজন বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষ এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে... তার আগে ওনার ভিভিড নেট এ্যাক্টিভিটি সেদিকেই নির্দেশ করে... মার্চে ভদ্রলোক ব্লগে প্রফেসরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, এবং এ্যাক্টিভিটি শুরু হয়... যাক সে প্রসঙ্গ অন্য এবং দুর্ভাগ্যজনক তার দিকে না যাওয়াই ভালো...
কিন্তু আমাদের এই লেখার পৃথিবী... সামান্য বাংলা লেখার পৃথিবী, বেরাদরি যেটা কয়েক দশক ধরে গড়ে উঠেছে... যেখানে প্রচুর পাগল পাগলী মনপ্রাণ দিয়ে পড়ে থাকে আর কিছু নয় শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দ দিয়ে তৈরী একটা লেখার আনন্দে... এবং লেখার সাথে এক মায়াবী যাপনের আনন্দে... তাদের কাছে বিপদটা আরো মারাত্মক... তাদের পেছনে কোনো বড় কর্পোরেট হাউস নেই, নিয়মিত নিউর‍্যাল আর মেন্টাল হেলথ চেক আপের জন্য হাউসের ব্যবস্থা করা মেডিকাল বোর্ড নেই... নেই কোনো রিজুভিনেশান বা রি-এনার্জাইজেশানের বিলাসবহুল পদ্ধতি... সবচেয়ে বড় কথা টাকা নেই... তা সত্ত্বেও এই যে লেখার আনন্দে লিখে যাওয়া কয়েক হাজার বাংলাপাগল (এই শিরোপাটা পেতে আমি সহ অনেকেই খুব তৃষ্ণার্ত থাকবে, হি হি) ছড়িয়ে আছে দুই বাংলা জুড়ে... তাদের সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে তারা তো প্রত্যেকেই ভয়ঙ্কর একা... লেখা জাপটে, লেখা জড়িয়ে, কেউ কেউ বাবা মার সাথে ঘ্যাচাং ফু করে, কেরিয়ার ঘ্যাচাং ফু করে, সম্পর্ক ঘ্যাচাং ফু করে পড়ে আছে লেখা, আঁকা, ছবি, সিনেমা এইসব কবুতরি পতাকার মতো উড্ডীন রেখে... কি বিশাল ইনভলভমেন্ট জড়িয়ে আছে ভাবা যায়, সমস্ত ইনভলভমেন্ট মাপলে হয়তো কয়েক কোটি মানুষের ইনভলভমেন্টে গিয়ে দাঁড়াবে, মানুষ সংসারও এত যত্নে করে না যতোটা এই জড়ানো, এই টান রাখতে করে...... তাদের ক্ষেত্রে কি হয়, তুই যেটা বললি, ক্লান্তিটা কোনোভাবেই বোঝা যায় না, এতে তো মেন্টাল ফিজিক্যাল টায়ার্ডনেস কিছু আসেনা... এফেক্টেড হয় ব্রেন ফাংশানিং... উদাহরণ দিয়ে বলি, কনশাসলি একটা লেখা লিখতে বা নির্মান করতে কি পরিমান চাপ পড়ে মাথায় আমরা ফীল করতে পারি। কিন্তু যখন লেখার ঘোর আসে, বা হু হু করে লেখা আসে তখন কি চাপ বোধ করি? করি না তো। কিন্তু চাপ ইকুয়াল কি তার বেশিই পড়ে... এটাও সেইরকম... ঝগড়াঝাটি নয়, তর্কবিতর্ক নয়, সিম্পল একটা কমেন্ট লিখতে গেলেও অজান্তে ব্রেন লেখার প্রক্রিয়ায় ঢুকে যায়... আমরা একটা ইল্যুশানে থাকি যে মামুলিভাষায় লেখা বা চ্যাট করা কথা বলাই... কিন্তু সেটা কথা বলা নয়, কখনোই নয়... কথা বলার সময় একটা বড়ো, মানে বিরাট বড়ো কাজ করতে হয় না... সেটা হলো অক্ষরকে শব্দকে ভিসুয়ালি রিকগনাইজ করতে হয়না... এটা একটা ম্যাসিভ প্রসেস... মামুলিভাষায় লিখলে, যতোই মামুলি ;লিখি আমাদের অক্ষর দেখে চিনতে হয়, শব্দ দেখে চিনতে হয়, বাক্যগঠন নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়... না চাইলেও হয়... এটা দিনের শেষে যোগফল হয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ইমপালস কন্ট্রোল করার ক্ষমতাকে এফেক্ট করে... একটা উদাহরণ দিলে বোঝাতে পারবো... এই লেখাটা যতোজন পড়ছে, আমি নিওশ্চিত তার মধ্যে ৮০ শতাংশ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে আত্মহত্যা নামক বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে... ভেবেছে আমি বলচি, চেষ্টা করেছে নয়... ভাবনা এসেছে, আসেই... প্রচণ্ড ডিপ্রেশানে মানুষ তার আল্টিমেট সর্বোচ্চ ক্ষমতার কথা একবার ভেবে ফেলেই, সেটা হচ্ছে নিজের প্রাণ নিজে ধ্বংস করার ক্ষমতা... সুইসাইড এ্যাটেম্পেটের অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা জানে শেষ মুহূর্ত অবধি মাথা কি করে বাধা দেয় এই ক্ষমতা, এই কার্টা ব্লাঙ্কা এ্যাপ্লাই করার... শেষ মুহূর্ত অবধি... ছাদে গিয়ে লাফিয়ে পরা অতো সহজ কাজ নয়, বা ট্রেণের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া... খুব কঠিন... ওইজন্য দেখা যায় ৭০-৮০% গলায় দড়ি দেওয়ার ঘটনা ঘটে ভোরে, ভোররাত্রে... কারন সারারাত ধরে মানুষ মাথার সাথে যুদ্ধ করে করে, অবশেষে তাকে কপ্নভিন্স করে শেষে সিদ্ধান্ত নেয়... আমাদের বাধা দেয় ওই ব্রেনের এ্যামিগডালা অংশটা... যা আমাদের ইমপালস কন্ট্রোল করে... রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আচমকা পাথরে হোঁচট খেলে ইনস্ট্যান্ট পাথরকে লাথি মারার ইচ্ছেটা কন্ট্রোল করে ওটাই...... এবার লেখার সময়, বাক্যগঠনকে ভিসুয়ালি রিকগনাইজ করার সময় জোর করে ওই এ্যামিগডালা অংশটিকে ফাংসানিং বন্ধ রাখতে হয়... কারন লেখায় ইম্পালস একটা বড়ো ফেভারেবল ফ্যাক্টর... ইমপালস না থাকলে উন্মাদ কল্পনা হয়না... ফলে কল্পনাপ্রবণ মানুষ নিজের কল্পনাপদ্ধতির সুবিধার্থে ব্রেনকে ট্রেন করে নেয় কিছু সিগন্যাল দিয়ে, যেমন আমি খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসলে বা বই পড়তে বসলে হে ব্রেন, তুমি এ্যামিগডালা অফ করে দিও... ব্রেন সেই সিগন্যালে অভ্যস্ত হয়ে যায়... ওই জন্য প্রেমিকার সাথে ঝগড়া যদি খাতায় লিখে লিখে করা হয় তবে তার মাত্রা সত্যি অন্যতর হয়ে যেতে পারে...... এবার যখন আমি নেটে বসে আছি, আমি একজন কল্পনাপ্রবণ, লেখার মানুষ, আমি চ্যাট করছি না, এমনি মামুলি চোখ বুলোচ্ছি ফেসবুকে, মেল পাঠাচ্ছি, সার্ফ করছি... একই সময়ে পাশের বন্ধুর সাথে আড্ডা মারছি, বা বাইরে বেরোচ্ছি মাঝে মাঝে... এবার কি হয়... হোক না যতোই মামুলিভাষা, আমি সিম্পল কমেন্ট লিখতে গেলেও, লিখছি, চোখ কাজ করছে কম্যুনিকেশানে দেখলেই ব্রেন এ্যামিগডালা অফ করে দেয়... আবার এমনি কথা বলার সময় অন হয়ে যায়... তার ওপর ফেসবুকে একেকটা কমেন্ট, একেকটা স্ট্যাটাস, একেকরকম ইনভলভমেন্ট নিয়ে লেখা হয়... কোনোটা আমার বিশ্বাস জানাতে, কোনোটা খিল্লি, কোনোটা পাতি পি আর, এগুলোতে ওই ইমপালস কন্ট্রোলটার রেগুলেটার ক্রমাগত বাড়ানো কমানো চলে... এরকম রোজ করতে থাকলে একটা ল্যাপটপের যেমন র‍্যাম দুর্বল হয়ে পড়ে, জাংক ফাইল জমে যায়, হুবহু মাথার মধ্যে হিউজ পরিমানে জাংক জমতে থাকে... আবর্জনা যাকে বলে... এবং এর চাপ পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়... জাংক ফাইল জমলে যেমন ল্যাপটপের কাজকর্ম বদলে যায়না জাস্ট ঝুলে যায়, মাথার ক্ষেত্রেও তাই হয়... কাজ, ফাংশানিং ঝুলে যায়, আমাদের অজান্তে... আর আমাদের সিদ্ধান্তের গুণগত মান পড়তে থাকে... কোয়ালিটি পড়ে যায়... এটা ছোটোখাটো সিদ্ধান্ত ইত্যাদিতে ম্যাটার করে না... কিন্তু যখন জীবনে সত্যিকারের টেনশান আসে, যখন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অতি অতি গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন যদি এ্যামিগডালা বা ইম্পালস কন্ট্রোল ফাংশানিম্নগ বন্ধ করে দেয় তাহলে সিদ্ধান্ত হয়ে যায় অতীব বিপজ্জনক... ঠিক যেভাবে একজন এ্যাডিক্ট তার নেশার প্রবল টান ঊঠলে হঠাৎ করে বিক্রি করে দেয় জিনিসপত্র... (আমার নিজের জানা একটা কেস স্টাডি, অতীব বুদ্ধিমান এবং অতি শিক্ষিত একজন হঠাৎ বসের ঘর থেকে ল্যাপটপ তুলে নিয়ে বাইরে বিক্রি করে এসেছিলো কুলকাল, তাও হার্ড ড্রাগ এ্যাডিক্ট নয়, এ্যালকোহোলিক, কি পরিমান ইমপালস কন্ট্রোল খারাপ হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে মানুষ)...... ঠিক সেরকম, একজন লেখার মানুষ একটা ফর্ম ফিলাপে নাম লিখলেও তার ব্রেনে লেখার ফাংসানিং চালু হয়ে যায় অজান্তে, এটা তার বহুদিনের প্যাশান, টান, জড়ানো থেকে আসে... তো এটা তো আরো বড়, একটা কমেন্ট, বা একটা স্ট্যাটাস…

অনেকেই বলছে ভয় পেয়ে যাচ্ছি, বা ফেসবুক করবোনা... এগুলো কোনো সলিউশান নয়... আসল সলিউশান লুকিয়ে আছে ওই মামুলিভাষা সম্পর্কে কনশাসনেসে... দুটো রাস্তা থাকে... হয় মামুলিভাষা ব্যবহারের কায়দায় তোমার কন্ঠস্বর ঢোকানোর, তোমার বডি ল্যাংগুয়েজ ঢোকানোর চর্চা করো... এটা একদিনে হবে না, কনশাসলি চেষ্টা করতে হবে কি করে গলার মডিউলেশান মামুলিভাষায় ঢোকানো যায়, কি করে চোখ পাকানো বাক্যগঠনে ঢোকানো যায়... একজন লেখার মানুষের কাছে এটা একটা উপাদেয় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই আসতে পারে...
আরেকটা উপায় হলো, এই মামুলিভাষা ব্যবহারের শ্রমটাকে রেজাল্টে কনভার্ট করা... অর্থাৎ, লেখার ভাষা, মামুলিভাষাকে জাক্সটাপোজ করার ক্ষমতা ডেভেলপ করা... যাতে এমন হয় যে স্ট্যাটাস, কমেন্ট ইত্যাদি কালেক্ট করে রেখে পরে সেগুলোকে লেখার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায়... আমি নিজে একটা জিনিস করি "কনভার্সেসানাল রাইটিং" বলে... দারুণ কাজে দেয়... কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে হলে, বা জীবনের কোনো ঘটনা নিয়ে লিখতে হলে, সোজা লিখতে না বসে কারর সাথে চ্যাট উইন্ডো খুলে তাকে বিষয়টা লিখে লিখে বলতে থাকি, তার রিপ্লাই আসে, সেটার রিপ্লাই করি, বলাটাও চালাই... আল্টিমেট চ্যাট রেকর্ডটাকে কমপ্লিট লেখা হিসেবে দাঁড় করাই... কথোপকথনের মাধ্যমে লেখা... এটা করতে শুরু করি একটা প্র্যাক্টিক্যাল প্রবলেমে পড়ে... এটা নিশ্চয়ই অনেকে ফেস করেছে... ধরা যাক জীবনে একটা কোনো খুব ইমপ্যাক্টফুল ঘটনা ঘটলো... খুব কমনটাই ধরি, সম্পর্ক ভাঙা, বা ব্রেক আপ, একটা খুব বাজে ব্রেক আপ পিরিয়ড গেল, প্রচুর ইমোশানাল দলমাদল... এরকম ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই মাথায় প্রচুর লেখা আসে, জীবন থেকেই তো লেখা, নানা ঘটনা, নানা আবেগ, নানা স্মৃতি, নানা কথা যা বলতে চেয়েও বলা হয়নি, নানা ভুল বোঝা, এইসব থেকে হু হুকরে লেখা আসে... একই সাথে হয় কি এইরকম সময়ে শেয়ার করতেও ইচ্ছে করে, মন সাপোর্ট চায় বন্ধুদের, কাছের মানুষের কাছ থেকে... আমার কি হচ্ছিলো দেখছিলাম, যে আমি এই শেয়ার করছি কারোর সাথে মনের কষ্ট, দুঃখ বা এ্যাগোনি বা সিম্পল তীব্রতা, চ্যাটে করছি কারর সাথে... এবার এরকম একজনের সাথে বহুক্ষণ লিখে লিখে শেয়ার করার পর, দেখতাম ওটা নিয়ে নিজের লেখা লেখার আর কোনো ইচ্ছেই পড়ে নেই, বা ইচ্ছে থাকলেও সেই আর্জ নেই... অথচ জীবনের ডকুমেন্টেশান জরুরী... নিজের কাছে এ্যাটলিস্ট... সিম্পল রাত্রে জার্নাল বা ডায়েরী লেখার সময় দেখতাম আর ইচ্ছে করছে না ওগুলো লিখতে... এই প্র্যাক্টিক্যাল প্রবলেম থেকেই আমি কনভার্সেসানাল রাইটিং আনি... কারোর সাথে শেয়ার করার সময়, যে কথোপকথনটা হয়, সেটাকেই কপি করে জার্নালে ফেলে রেখি, বা ডায়েরীতে... আমাই যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তা হবে সম্পূর্ণ কনভার্সেসানাল... এতে সুবিধে হয় কি আবেগ শেয়ারিং এর সময় সামান্য হলেও ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড কাজ করে এটা একটা লেখার উপকরনও বটে... এবং সেরকমভাবে বাক্যগঠন হয়, ইত্যাদি... (বাই দ্য ওয়ে লেখার উপকরন বলতে আমি লেখা প্রকাশের কথা বলছি না, প্রকাশ করার লেখার থেকেও অপ্রকাশের লেখা তো একজন লেখার মানূষকে কয়েকগুণ বেশী লিখতে হয়, সেইগুলো... এটা কোনো না জানিয়ে মানুষকে ব্যবহার করার জটিল জায়গা নয়)...
এবার এই দুটি আমি বললাম, যতো বেশী মানুষ সচেতন হবে, ততো বেশী রাস্তা বেরোবে এর থেকে বাঁচার... কিন্তু বিপদটা অস্বীকার করলে তার থেকে খারাপ আর কিছু হবে না...
থ্যাংক্স উর্মি, তর জন্য এই ফলো আপ টা লেখা হলো, খুব জরুরী ছিলো লেখা...
পুনশ্চ- আবার বলছি, ফেসবুক করা কমানো, চ্যাট বন্ধ করা এগুলো সলিউশান নয়, এগুলো বালিতে মুখ গুঁজে বিপদ অস্বীকার করা মাত্র। নিজের একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি।

মাত্র দু বছর আগে আমি অজান্তে ভয়াবহ এ্যানালিসিস প্যারালিসিস এর শিকার হয়েছিলাম। অনেকের উল্লেখ করলেও মনে পড়বে। আমার লেখার সমালোচনার পালটা সমালোচনা আমি সচরাচর করিনা। কারন সমালোচনাও একটা রিয়াকশান। এই ফেসবুকেই আমার কোনো একটি স্ট্যাটাস বা কমেন্ট নিয়ে একজন সমালোচনা করায় আমি হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে পালটা লিখে বসি অনেকগুলো, মস্তো মস্তো। যুক্তিযুক্ত এবং বেশ লেখাবস্তু সমন্বিত হলেও সেগুলোর মধ্যে আক্রমণ ঢুকে ছিলো ভয়ঙ্কর। এবার হতো আমি খেয়ালই করতাম না, কারন মোটামুটি একটু "পণ্ডিত লেখক" টাইপের নাম হলে লোকজন খুব একটা সামনা সামনি কিছু বলে না। কিন্তু সেবার আমার বিরাট উপকার করেছিলো অনুপম। মানে অনুপম মুখোপাধ্যায়। অনুপম আমাকে একটা ছোট্ট কমেন্ট করেছিলো "বেবী, এত আমি কেন?" ... আমার যেন ৪৪০ ভোল্টের শক লাগে এবং একটা ঘোর কেটে যায়, আমার নিজের কমেন্ট পড়ে নিজের মুখ লুকনোর জায়গ ছিলনা নিজের কাছে... ক্ষমা টমা চাওয়া তো করে নেওয়া হলো, কিন্তু তাতেও কাটেনা এই বিস্ময়... এরকম কি করে হলাম, বা লিখলাম আমি!! এতদুর যে তারপর প্রায় আট মাস ফেসবুকে ঢুকিনি... সেইসময়তে বুঝেছিলাম, এই ক্লান্তি কি ভয়ঙ্কর, এবং কেমন অজান্তে কাজ করে... এ নিয়ে আমার আরো অন্যান্য অবজার্ভেশান একে একে লিখবো। আপাতত এটুকুই।

অমিতাভ প্রহরাজ

No comments:

Post a Comment