এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

সতীশ বিশ্বাস



ছড়াক্কা-গাথা



একলব্য

একদিন দ্রোণাচার্য শিষ্যদের ডেকে
বলেন, ‘শিষ্যগন,
সবাই কর শ্রবণ—
দেব আমি যে নির্দেশ
তা হবে চূড়ান্ত,শেষ।
নির্বিবাদে পালন করবে আজ থেকে।’

দ্রোণের এ কথা শুনে শিষ্যরা নীরব।
দ্বিধাণ্বিত চেয়ে থাকে।
কেবল অর্জুন বলে,
‘দেবেন যে ভার আমাকে,
ছলে বলে কৌশলে
পালন করতে দেব শক্তিটুকু সব।’

খুশি হয়ে দ্রোণাচার্য করেন ঘোষণা—
‘শোন প্রিয়তম শিষ্য,
নও তুমি অবিমৃশ্য।
আমার যা বিদ্যা জানা
তোমাকে তা ষোল আনা
দেব; আর কাঊকেতা কিছুতে দেব না।’

একী কথা বললেন গুরুদেব দ্রোণ!
তুমি তো শিক্ষাগুরু
তবে কেন লঘু-গুরু?
সব ছাত্রে সমদৃষ্টি-
নয় কি শিক্ষকের কৃষ্টি?
ঠিক কি তোমার চোখে ভেদ থাকা কোন?

সেই থেকে নিলে তুমি ছলের আশ্রয়।
অন্য সব ছাত্রদের
গঙ্গাজল আনতে বলে
শিক্ষা দিতে অর্জুন ও
স্বপুত্রকে কৌশলে।
তোমার এ আচরণ অনুচিত নয় ?

সব ছাত্র জল আনতে হেঁটে গেলে দূরে
অর্জুন যাবে না কেন?
সবাই তো  রাজ-পুত্র
কেউ না বৃহৎ,ক্ষুদ্র;
কেন দিলে অনুমতি
অর্জুনকে আনতে জল বরুণ-অস্ত্র জুড়ে?

পুত্রের ক্ষেত্রেও দেখিয়েছ পক্ষপাত।
পুত্র তো সকল ছাত্র
সমান স্নেহের পাত্র।
ছেলে বলে বেশি শিক্ষা!
গুরু হয়ে একী দীক্ষা!
তবুও কি আশা কর শ্রদ্ধা,প্রণিপাত?

এরপর একদিন এক নিষাদযুবক
হিরণ্যধনুর ছেলে,
‘একলব্য’ নাম তার ;
শিষ্য হতে কাছে এলে
দিলে তাকে ধিক্কার।
বললে নিষ্ঠুর কথা জাত-বিষয়ক!

বললে,‘ভুলে কি গেলি--তুই নীচু জাতি?
আমার শিষ্য যারা,
উচ্চবর্ণজাত তারা
কিম্বা রাজার পুত্র।
তুই তো চন্ডাল, শূদ্র।
তোকে শিক্ষা দিলে রটে যাবে অখ্যাতি।’

ব্যথা পেল একলব্য। তবুও নীরবে
দ্রোণকে প্রণাম ক’রে
ফিরে এল নিজ ঘরে।
নিষাদের বেশ ছেড়ে,
ব্রক্ষ্মচারী রূপ ধ’রে
স্থির করে নিল মনে-কী করতে হবে।

গড়ল এক দ্রোণাচার্য মূর্তি মাটি দিয়ে।
পরল জটাবল্কল।
জোগাড় করে মূল,ফল
করতো রোজ আহার।
অরণ্যে বাস তার;
দ্রোণের করতো পুজো নানা ফুল সাজিয়ে।

অধ্যবসায় আর নিষ্ঠার বলে
ধীরে ধীরে একলব্য,
যেন ছিল ভবিতব্য,
শপথে থেকে অনড়
হল মহা ধনুর্ধর।
মনে তার সর্বদা গুরুমূর্তি জ্বলে।

একদিন শিকারে এল কুরু-নন্দনেরা
সঙ্গে কুকুর ছিল
পান্ডবের অনুচর
চীৎকারে সে করে তোলে
অরণ্যস্থল মুখর।
ভাঙে তাতে শিষ্যের ধৈর্যের বেড়া।

‘স্তব্ধবান’ ছুঁড়ে মারে একলব্য রেগে।
কুকুরটি মরল না,
মুখেও হল না ঘা।
শুধু বন্ধ হল শব্দ,
পরিবেশ হল স্তব্ধ।
জব্দ কুকুর গেল প্রাণ নিয়ে ভেগে।

পান্ডবেরা তিরবিদ্ধ দেখে সে কুকুর
চূড়ান্ত অবাক হল;
কারণ কখনো তারা
দেখেনি এমন আগে।
কে শিখলো-তারা ছাড়া
এ বিদ্যা!- দেখতে এল ক্রোধে ভরপূর।

এসে একলব্যকে জিজ্ঞাসা করে
‘নাম ধাম বলো,আর
দাও বিবরন।
কার কাছে এই বিদ্যা
করেছ অর্জন।
কে এমন গুরু আছে এই চরাচরে?’

নিষাদতনয় বলে নম্র কন্ঠস্বরে,
‘আমি একলব্য, আর
হিরণ্যধনু পিতা।
যিনি পুজ্য গুরুদেব,
দ্রোণাচার্য নাম তার।’
শোনামাত্র অর্জুন ফিরে যায় ঘরে।

দ্রোণাচার্য বিস্মিত অর্জুনকে দেখে
বললেন, ‘এখানে কেন?
বলো--কী ঘটলো হেন?
সব্বাই একসাথে
শিকারশূন্য হাতে
মাঝপথে ফিরলে মৃগয়া বন্ধ রেখে!’

সোজাসুজি অভিযোগ করে অর্জুন।
‘একদিন বলেছিলে
আমি হব সেরা ছাত্র।
কিন্তু সেটা সত্য নয়,
আমি নই প্রিয়পাত্র।
বলো, কেন শেখালে না দুর্লভ এক গুণ?

ভাবলেও লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
যে বিদ্যা থেকে গেছে
অজানা আমার,
সে বিদ্যার অধিকারী
নিষাদ-কুমার!
কেন করলে এ চাতুরি জানাবে আমায়?’

’কী হয়েছে খুলে বলো,’ দ্রোণাচার্য বলে।
অর্জুন তখন সব
ঘটনা বলল তাঁকে।
শুনে দ্রোণ নীরব ও
কিছুটা বিব্রত থাকে।
তারপর বলে, ‘নিয়ে চলো সেই স্থলে।’

গুরুকে দেখেই শিষ্য কৃতাঞ্জলি পুটে
দাঁড়িয়ে বলল, ‘প্রভূ,
ভাবতে পারিনি কভু
আসবেন সশরীরে
গরিবের এ কুটিরে।
তোমার আশিসে যাক সব অজ্ঞতা টুটে।

কীভাবে করব প্রভূ আপনার সেবা?’
দ্রোণ কয়, ‘প্রমাণ কর
আমার শিষ্য কিনা।
যদি হও শিষ্য তবে
দাও গুরুদক্ষিণা।
শুধুমাত্র কথাকে বিশ্বাস করে কেবা?’

একলব্য বলে, ‘আছে যা কিছু আমার
সবই আপনার।
যা আদেশ করবেন
নিশ্চিত তা পাবেন।
মুখে শুধু বলুন একবার,
দেব তা আপনাকে--করলাম অঙ্গীকার।’

দ্রোনাচার্য বলে,’যদি খুশি করতে চাও,
যত সব অস্ত্রবিদ্যা
অর্জন করেছ,তার
মূল্য হিসাবে চাই
ছোট এক উপহার–
দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধ অঙ্গুলিটি দাও।’

বজ্রাঘাত প’ল শিরে। দুই চোখে তার
নামল আঁধার।
ভাবলো সে-- আজ তবে
এতদিন যা করেছি,
সব কিছু মিথ্যা হবে!
সব স্বপ্ন ভেঙে আজ হবে ছারখার!

মুহূর্তে সামলে নিয়ে শিষ্য একলব্য
গুরুর সে নির্দেশ
করল শিরোধার্য।
আঙুল কাটতে দেখে
হাসল দ্রোণাচার্য!
গুরুদেব,ধূর্ত,নীচ,শিক্ষিত ও সভ্য।


সতীশ বিশ্বাস

No comments:

Post a Comment