ছোটগল্প
হুইল চেয়ার ড্যান্সার
অনেক অভিমানের মেঘ ঘনীভূত হয়ে ঝরে পড়ল শর্মিলার দু গাল বেয়ে। সে তো পরাজয় স্বীকার করে নি, হার মানে নি, তবে তার কিসের কষ্ট! শ্যামল প্রকৃতির অবিশ্রান্ত বর্ষণ কি শর্মিলার হৃদয় নদীতে প্লাবন এনে দিল। তার যে আজ ভীষণভাবে মনে পড়ছে বিগত দিনগুলোর কথা।
প্রখ্যাত অর্থপেডিক্সের মেয়ে হয়েও শর্মিলা পড়াশোনায় মনযোগ দেওয়ার থেকে নৃত্যশিল্পী মায়ের নাচের দিকেই বেশি ঝুঁকেছিল। ক্রমশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল মাকেও। পরে আরও বড় বড় নৃত্যশিল্পীর কাছে নৃত্যশিক্ষা নিয়ে অনেক সাধনা করে শর্মিলা দত্ত উঠেছিল খ্যাতির চরম শিখরে। দেশে-বিদেশে,মঞ্চে,দূরদর্শণে নিয়মিত অনুষ্ঠান তার। একদিন অনুষ্ঠান শেষে বেশ রাত্রেই বাড়ি ফিরছিল শর্মিলা। সেদিনও আকাশ ফুটো হয়ে এমনই অঝোর ধারায় পড়েই চলেছিল। ঘটল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। একটা ট্রাকের সঙ্গে তাদের গাড়িটার মুখোমুখি ধাক্কা,শর্মিলার গাড়ির ড্রাইভার তো সঙ্গে সঙ্গেই মারা গিয়েছিল। শর্মিলা অনেক চিকিৎসার পর প্রাণে বাঁচলেও তার পা দুটি বাদ দিতে হয়েছিল। মেরুদণ্ডেও কিছুটা চোট লেগেছিল-তাই হুইল চেয়ারই হল শর্মিলার সর্বক্ষণের সঙ্গী। শর্মিলার বাবা ডঃ শ্যামল দত্ত নিজে বড় অর্থপেডিক্স। তাঁর এবং বিভিন্ন ডাক্তারের সুচিকিৎসায় আর মায়ের যত্নে শর্মিলা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও তার মনের সুস্থতা এল কই? কোথায় গেল তার অগণিত স্তাবকের দল,সব যেন কর্পূরের মত উবে গেল। আর মস্ত ইঞ্জিনিয়ার সূর্য্য্ সেন- শর্মিলার একান্ত আপণ-তার ভালবাসার জন-দুর্ঘটনার একমাস পরেই যার সঙ্গে শর্মিলার বিয়ে হত-সেই সূর্য্য মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিল-চলে গেল আমেরিকা। সেখানেই বিয়ে করে পাকাপাকি ভাবে রয়ে গেল।
শ্যামলবাবু ও তাঁর স্ত্রী মৃন্ময়ীদেবীর অদম্য চেষ্টায় শর্মিলা শারীরিকভাবে ক্রমশ বেশ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল-কিন্তু দেখা দিল অন্য সমস্যা। হুইল চেয়ারে বসে বসে তার শরীরের পেশীগুলো আড়ষ্ট হতে থাকল। বেশ ব্যথা-বেদনা আরম্ভ হয়ে গেল। হুইল- চেয়ারে বসা রুগীদের এ এক বিরাট সমস্যা। অভিজ্ঞ শ্যামলবাবু শর্মিলাকে প্রতিদিন ব্যায়াম করানোর জন্য দক্ষ ফিজিওথেরাপিস্ট রাখলেন। সুশিক্ষিত থেরাপিস্ট বিভিন্ন ব্যায়াম নিয়মিত শর্মিলাকে আস্তে আস্তে অভ্যাস করাতে লাগলেন। শর্মিলার পেশীর আড়ষ্টতা কাটলেও মনের আড়ষ্টতা কাটতে কিছুতেই চাইছে না-অতবড় একটা দুর্ঘটনা-মনমরা হয়েই সে থাকে সবসময়। মৃণ্ময়ী দেবী সব বুঝতে পারেন-বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী শর্মিলা দত্ত আজ একদম পঙ্গু,এ কি মেনে নেওয়া যায়! মৃণ্ময়ী দেবী তো মা, তাই সবসময় চিন্তা করেন মেয়ের জন্যে। ফিজিওথেরাপিস্টের মুখে তিনি শোনেন যে বিদেশে হুইল চেয়ারে বসা রুগীদের সুস্থ করা ও আনন্দ দেবার জন্যে মিউজিকের তালে তালে তাদের নিয়ে বিভিন্ন নাচের মুদ্রার প্রচলন আছে। তাতে শারীরিক অবসাদই নয় মনের অবসাদও কাটে। পেশীরও সঞ্চালন হয় ফলে ব্যথা বেদনা থেকেও বেশ রেহাই পাওয়া যায়। হুইল চেয়ারে বসা রুগীদের নিয়ে তিনি তাঁর চিন্তা-ভাবনার কথা শ্যামলবাবুকে জানালেন। শ্যামলবাবুও মহা উৎসাহে বিদেশ থেকে সি.ডি আর ইন্টারনেট থেকে নানান হুইল- চেয়ারের নৃত্য সংগ্রহ করতে থাকলেন। মৃণ্ময়ী দেবী ও ফিজিওথেরাপিস্ট অঞ্জনবাবুর চেষ্টায় সেগুলি তাঁরা শর্মিলাকে শেখাতে লাগলেন। শর্মিলাও নতুন একটা পথের সন্ধান পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেল। শরীরের অসুখের থেকেও তার মনের অসুখ ক্রমশই সেরে যেতে লাগল। বাবার কাছে শর্মিলা শুনল যে ঐ হুইল চেয়ারে বসে বসে অনেকেরই বসা অংশগুলোতে দগদগে ঘা হয়ে যায়-অনেক সময় ওষুধ দিয়েও সারে না-এমন কি অপারেশন পর্যন্ত করাতে হয়। তার মাথায় যেন এক নব চেতনার উদয় হল। ভারতবর্ষের সব হুইলচেয়ারবাসীর জন্য শুরু হল তার সাধনা। মায়ের সহযোগিতায় আর অঞ্জনবাবুর সুপরামর্শে ও শিক্ষায় শর্মিলা হুইল চেয়ারে বসেই মিউজিকের তালে তালে নানান নতুন নৃত্য-ভঙ্গিমার সৃষ্টি করতে লাগল যেগুলো হুইল-চেয়ারে বসা রুগীদের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রযোজ্য। ঐ চেয়ারে বসা বাবার রুগীদের নিয়ে তৈরী করল “হুইল-চেয়ার ড্যান্স গ্রুপ”-নাম দিল-“আমাদের জয়”। এখন তো শর্মিলার ঐ নাচের টিম ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে হুইল-চেয়ার ড্যান্স প্রদর্শন করে আসে।
“আমাদের জয়” ড্যান্স গ্রুপের খ্যাতি ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। শর্মিলা বহু জায়গায় সম্মানিত,পুরস্কৃত হতে থাকল তার মায়ের অদম্য সহযোগিতায়,তবুও শর্মিলার মনে কালো মেঘের ছটা মাঝে মধ্যেই ঘনিয়ে আসে। সূর্য্যের তপস্যা তাঁর শেষ হয় নি। তার এখন বড় প্রয়োজন একজন প্রকৃত প্রেমিকের- সে শুধু ভালইবাসবে না- বন্ধুর মত পাশে থেকে তাকে সাহস যোগাবে,সাহচর্য্য দেবে,তার সন্তানের পিতা হবে-সেও তো নারী-মা হওয়ার জন্য তার অন্তর তাই গুমরে গুমরে কাঁদে। শর্মিলাকে শ্যামলবাবু দুজন নামকরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন-প্রত্যেকেই বলেছেন শর্মিলার মা হওয়ার ক্ষমতা পূর্ণমাত্রায় আছে। সে সন্তান উৎপাদন ও ধারণ করতে পারবে। তবুও হুইল চেয়ারে উপবিষ্টার জীবনে নতুন সূর্য্য কি আর উঠবে? শর্মিলার চিন্তার ছেদ পড়ল অসময়ে ডোর বেলের আওয়াজে। আয়া দরজা খুলে দিতেই শ্যামলবাবু একজন অচেনা যুবককে নিয়ে ঢুকলেন। শ্যামলবাবু চন্দ্রকান্তের সঙ্গে শর্মিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। চন্দ্রকান্তের বোন সুপর্ণার নিদারুণ এক দুর্ঘটনায় শুধু পা দুটোই খোয়া যায় নি,অভাগী সেই দুর্ঘটনায় একসঙ্গে হারিয়েছে তার বাবা-মা দুজনকেই। তাই শুধু শারীরিকই নয় মানসিক ভাবেও সুপর্ণা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চিকিৎসার খরচ যোগাড় করতে বেসরকারী অফিসের অল্প মাইনের চাকুরে চন্দ্র একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে;তবুও সে হাল ছাড়ে নি। ভাল চিকিৎসার আশাতেই সুদূর মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে চন্দ্র ছুটে এসেছে বোনকে নিয়ে। সব শুনে শর্মিলার সমব্যথী মন গলে গেল। শর্মিলার তো তবু মা-বাবা আছেন- সুপর্ণার তো দাদা ছাড়া আর কেউ নেই। তবে অনেক ভাগ্য করে সুপর্ণা দাদাকে পেয়েছে- চন্দ্রের মত এমন হৃদয়বান,দায়িত্বশীল ছেলে সত্যিই বিরল। শ্যামলবাবু ও শর্মিলা দুজনে মিলেই সুপর্ণাকে চিকিৎসা ও দেখাশোনা করবেন ঠিক করলেন, কিন্তু তার জন্য তো সুপর্ণাকে শ্যামলবাবুর বাড়িতে থাকতে হবে। প্রথমে সুপর্ণা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না-কেবলই কান্নাকাটি করছিল কিন্তু শর্মিলার সুন্দর ব্যবহার ও মৃণ্ময়ী দেবীর আপ্যায়নে সুপর্ণা রাজি হল- না হয়ে তো উপায়ও ছিল না।
নামমাত্র খরচেই শ্যামলবাবু সুপর্ণার চিকিৎসা শুরু করলেন,চন্দ্রকান্তকে তাঁর বড় ভাল লেগেছিল-গ্রামের সাদামাটা ছেলে-দয়া,মায়া,ভালবাসা,সততা সব গুণই তার মধ্যে আছে। শর্মিলা ও মৃণ্ময়ী দেবী সুপর্ণাকে মানসিক নিরাপত্তা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন। আস্তে আস্তে সুপর্ণার মানসিক আর শারীরিক উভয়দিকেই বেশ উন্নতি ঘটতে থাকল। সপ্তাহান্তে চন্দ্র একবার এসে বোনকে দেখে যায় আর অজস্র কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যায় শর্মিলাকে। শর্মিলাও চন্দ্রের সুন্দর ব্যবহার আর তার শক্তপোক্ত মেদহীন শরীরের প্রতি ক্রমশই আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিল। এভাবেই শর্মিলার জীবনে সূর্য্য অস্ত গেলেও জ্যোৎস্না- ঝরানো চাঁদের আলোর প্রভা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। শ্যামলবাবুও একজন বিশ্বাসী সহকারী খুঁজছিলেন তাঁর নার্সিংহোমের জন্য। পরিশ্রমী,নির্লোভ চন্দ্রকান্তকেই তিনি সেই পদটি দিলেন। সুপর্ণার জন্য চন্দ্র রাজীও হয়ে গেল। মৃণ্ময়ী দেবী কিন্তু মেয়ের মনের কথা জানতে পেরে চন্দ্রকান্তের কাছে প্রস্তাব দিলেন শর্মিলার সারাজীবনের ভার নেওয়ার। চন্দ্র বলল, “আমি আপনাকে জানাতাম মাসীমা,শর্মিলা ও আমি পরস্পর পরস্পরকে ভালবাসি।” শর্মিলার জীবনে অমাবস্যা কেটে পূর্ণিমার আলো ঝরে পড়ল।
ডঃ রমলা মুখার্জি |
কবি পরিচিতি
আমি রমলা মুখার্জি,
এস সি, পি এইচ ডি, এম এ, বি. এড, সংগীত প্রভাকর, নৃত্যে সিনিয়র ডিপ্লোমাপ্রাপ্তা ।শিক্ষিকা, কবি, ছড়াকার, গল্পকার, নাট্যকার। আমি গান, আবৃত্তি, নাটকও করি। আমি 2003সালে ছড়া, কবিতা, গান, নৃত্য, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে বিজ্ঞান পাঠদান ও অন্যান্য সমাজ সচেতনমূলক কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাই।
আমি প্রধান শিক্ষিকা ছিলাম। অবসরের পর এখন অতিথি শিক্ষিকা। আমি কিছু বই লিখেছি। স্বরচিত ছড়া, কবিতা, শ্রুতি নাটক, গান ইত্যাদি আমরা মঞ্চস্থ করি। অনেক সাহিত্য ও বিজ্ঞান সংস্থা থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছি । শুভেচ্ছা জানাই ।
ডঃ রমলা মুখার্জী, বৈঁচী, বিবেকানন্দ পল্লী, হুগলি,
ডাক সূচক ৭১২১৩৪। পশ্চিমবঙ্গ
ডাক সূচক ৭১২১৩৪। পশ্চিমবঙ্গ
No comments:
Post a Comment