লোকসংস্কৃতি
(ধারাবাহিক)
(ধারাবাহিক)
“তিনি কাব্যের কিছুই বুঝিবেন না, অথচ কাব্যপাঠে এবং সমালোচনায় প্রবৃত্ত, যিনি বারঘোষিতের চীৎকার মাত্রকেই সঙ্গীত বিবেচনা করিবেন, যিনি আপনাকে অভ্রান্ত বলিয়া জানবেন, তিনিই বাবু।“
( প্রবন্ধ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
---হ্যাঁ, এমনই ছিল সেদিনের ‘সুটানুটী সমাচার’। জাহাজ, লবণ, বাঁশ এসবের ব্যবসা বানিজ্য করতে শুরু করে এককথায় উঠতি বড়লোক হয়ে উঠে। নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলা তাঁর দেওয়ান শ্যামরাম সোমকে প্রথমবার যে ‘বাবু’ খেতাব দিয়েছিলেন, সেই পরম্পরা প্রশস্ত হয় খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। সেকেলের কলিকাতা (ডিহি কলিকাতা – সুটানুটী _গোবিন্দপুর সম্মিলিত অঞ্চল) অষ্টভূজা হয়ে উঠেন রামতনু দত্ত, নীলমনি হালদার, গোকুলচন্দ্র মিত্র, রামকৃষ্ণ দেব, ছাতু সিংহ, দর্পনারায়ন ঠাকুর, রাজা সুখময় রায় এবং মিত্র পরিবারের (চোরবাগান) এক ধনিল সন্তানের জন্যই। এঁদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে একটাই উপমা আমাদের মাথায় আসে---’সুখের পায়রা’। খাজাঞ্চিখানা, তোষাখানা, আস্তাবল, গাড়িবারান্দা, নাচমহল, দুর্গাদালান, চিকের আড়ালের পরদে পরদে জমে উঠেছিল সৌখীন প্রতিযোগিতা।
এইসব নববাবুদের আমোদ-আহ্লাদের জোগান দিতে আদি গ্রামীন সংস্কৃতির বাহক শিল্পীরা সুটানুটীর চিলেকোঠায় সাজবদল করে এক বিচিত্র বা মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সাতমহলা অট্টালিকাকে গোলাপ জল দিয়ে ধোয়া, পোষা বিড়ালের বিয়েতে ভুরিভোজের আয়োজন, উপপত্নীকে নিয়ে মাহেশের রথের মেলায় যাওয়া, দুর্গাপুজোয় সেকালের সর্বাধিক লোকপ্রিয় যাত্রা বিদ্যাসুন্দর পালা অভিনয়ের পাশাপাশি শীতকাল পড়লেই এক বিপুল আসর বসত ‘বুলবুলির লড়াই’ এর। নাহ, সেই বাংলার সোনার ধানক্ষেতে মই দেওয়া বর্গিদস্যু বুলবুলি নয়;সত্যিকার বুলবুলি পাখী। এই বুলবুলির লড়াই এর জন্য অবশ্যই আমাদের শ্রীযুত রামদুলাল দে সরকারের কার্তিক-গনেশবৎ দুই পুত্র আশুতোষ দেব (ছাতুবাবু) ও প্রমথনাথ দেব (লাটুবাবু) – এর নাম করতেই হয়। অবশ্য পোস্তার সুবংশ লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নকুধরের পরিবার ও এই বিষয়ে একাংশেও নীচ নয়। আজকে যেখানে মিনার্ভা থিয়েটার (বিডন স্ট্রীট) অবস্থিত, সেই স্থানটি একদা ছাতুবাবু-লাটুবাবুর মাঠ বলে পরিচিত ছিল। কিংবদন্তী অনুসারে ছাতুবাবুর ১৫০টির মত বুলবুলি পাখী ছিল। ১৮৫৩ সালে(খ্রীষ্টাব্দে) সিমুলিয়ার বাবু দয়ালচাঁদ মিত্র ও জোড়াসাঁকোর রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের পরিবারের দুইপক্ষের মধ্যে ৩৭ বার বুলবুলির লড়াই হয়েছিল এবং সেখানে বাবু দয়ালচাঁদ – ই জিতে গিয়েছিলেন। এই ধারাটিই ক্রমে এতটাই গণচিত্তকে অধিকার করে নেয় যে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় বুলবুলির লড়াই এর মত বিষয়কে উপেক্ষা করে প্রতিবেদন জানানো হয়নি বলেই সম্পাদক শ্রী ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটূ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল।
পাখী নিয়ে অকারণ বিলাসিতার অন্ত ছিলনা বাবুদের। একবার গোবিন্দ অধিকারীর ‘রাধিকার মানভঞ্জন’ যাত্রাপালার পরিবেশনের সময় বাঁশের খুঁটিতে পাখীর খাঁচা ঝোলানো হয়েছিল।
মধ্যযুগের পাঁচালিগান, পালাকীর্তন শহর বা শহরের উপকণ্ঠে এসে গরুর গাড়ির ছইয়ের মধ্যে থেকেই আকাশ ছুঁতে চাইল এই সময় থেকেই। প্রচলিত মনোহরশাহী কীর্তনের বেড়া ভেঙে ঢপকীর্তনকে ছড়িয়ে দেন মধুসূদন কিন্নর। এছাড়াও পৌরাণিক শিব, দুর্গা, কালী, কৃষ্ণ, রাধাকে অবলম্বন করে তৎকালের প্রেক্ষিতে কবিগান (দাড়া ও বসা) এর ‘চাপান-উতোর’ পর্যায়ে ঝড় তুলে দেন কবিয়াল হরু ঠাকুর (হরেকৃষ্ণ দীর্ঘাঙ্গি), ভোলা ময়রা, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি প্রমুখেরা। এভাবেই চলতে থাকে ‘বাবু কালচার ’।
একদিকে বটতলা থেকে প্রধানতঃ অশ্লীল বিষয়ে প্রকাশিত সচিত্র গ্রন্থ, অন্যদিকে শুধুমাত্র দম্ভপ্রকাশের দুর্গাপুজোয় পাঁচালি, ঝুমুর, তর্জা, খেউড়, টপ্পা, সখীগ্রা সংবাদ প্রভৃতি গানের অনুষ্ঠন বাবুদের যৌন উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দেয়। শ্রীহীন, অপরুচিপূর্ণ গ্রাম্যতাস্বরভাবদুষ্ট আদিরসাত্মক শিল্পই তখন উচ্চাঙ্গের মর্যাদা পায়। শিল্প সবসময়েই সাময়িক রুচি, অভ্যাস, পছন্দকে অনুসরণ করে চলে, তাই ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের মত বটতলার প্রকাশক, বা ভবানী বেনের মত কবিয়ালরা সংসারের ভার বহন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এমনই সময়ে রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শিবচন্দ্র ঠাকুর (মতান্তরে মুখোপাধ্যায় ) এর উদ্যোগে একঝাঁক পাখী বাগবাজারে উড়ে এসে জুড়ে বসে। এরা কোনও বাস্তবিক ডানাওয়ালা পাখী নয়। এরা মানুষের ভেকধারী রক্তচক্ষু গাঁজাভক্ত পাখী। সেদিনের বাগবাজার ক্রমশঃ ভরে যাচ্ছিল এই পাখীর দলের ডানা- ঝাপটানিতে। কোনও আটচালাতে ছিল এদের পাঠশালা। এই দলের সভ্য হতে গেলে নিদেনপক্ষে ১০০ ছিলিম গাঁজা বিনা শ্বাসকষ্টে সেবন করতে হ’ত। এভাবেই ১০৮ ছিলিম গাঁজা নির্বিঘ্নে টানতে পারলেই একটি করে ইট পেত এবং সেই দিয়ে নিজের বাড়ি বানাতে পারলে তবেই যথার্থ পাখীর সম্মান পেত কোনও সদস্য। একবার এক যুবক ৯৯ ছিলিম গাঁজা টেনেই কেশে ফেলবার জন্য তাকে ‘ছাতার পাখী’র পদ দেওয়া হয়। শোভাবাজার রাজবাড়িতে এই ধরণের পক্ষীসম্প্রদায়রা প্রায়ই কৌতুক, নকশার প্রদর্শন করে আসত। তবে এরা খেয়ালীও ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। তাদের গাড়ি বা বাহনগুলিকে তারা নিজেরাই বলত খাঁচা। পক্ষীসম্প্রদাযে়র মধ্যে কাঠ্ ঠোকরা, বুলবুলি, ময়না এইরকম বিভিন্ন পদমর্যাদার পাখীরা থাকত এবং নাম শুনেই বোঝা যায় যে এদের চরিত্র কীরূপ হতে পারে। কাঠঠোকরা সবসময়েই আত্মদম্ভী মানুষদের ঠুকরে সত্যি কথা বের করে আনত।
পাঁচালিকার গঙ্গা নস্করও এমনই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। টপ্পাশিল্পী রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবুর সঙ্গেও এরকম এক পক্ষীসম্প্রদাযে়র নিত্য যোগাযোগ ছিল। বাগবাজার বৌবাজার বটতলা সম্মিলিত তখনকার মানচিত্রে দেড়জন সুপ্রসিদ্ধ পাখীর নাম পাওয়া যায় - - প্রথমজন রূপচাঁদ পক্ষী ও দ্বিতীয়জন নিতাই পক্ষী (ইনি সম্পূর্ণ পক্ষী নন)।
রূপচাঁদ পক্ষীই ছিলেন সেকালের ‘পক্ষিরাজ’ বা ‘খগরাজ’। ১২২১ বঙ্গাব্দে (বর্তমানের) উড়িষ্যাপ্রদেশে তাঁর জন্ম। পিতার কর্মসংস্থানের জন্যই কলিকাতায় এসে পৌঁছান। তদানীন্তন আখড়াই গানে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সঙ্গীতজীবনের প্রথম লগ্নে ‘পক্ষীর জাতিমালা’ নামক এক পাঁচালিসংগঠন ও গড়ে তোলেন। বাগবাজারের সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেই তিনি ও কৌতুক বা নকশাজানিত গান বাঁধতে থাকেন। তাঁর গানগুলি বিদ্রূপাত্মক হলেও সেগুলির মাধ্যমে আমরা পুরোনো কলিকাতার ইতিহাস ও অনেকখানি পেয়ে থাকি—
নন্দনকানন ইডেনগার্ডেন সম নিছনি, ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, কলকাতাতে ফিটেন রথ পারিজাতকে করে মাত গোলার সেঁউতি নাগেশ্বর শিক্ষক ডিরোজিও মহাশয়ের দ্বারা প্রভাবিত নব্যবঙ্গীয় রেভারেণ্ড কৃষ্ণ মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুর, মধুসুদন দত্তদের আচার ব্যবহারের কথা ও তাঁর গানে আমরা পাই - - -
চাল বাড়ালে ইয়ং বেঙ্গল
পানীয় দোষে চক্ষুলাল
শুধুমাত্র ‘সধবার একাদশী’ (দীনবন্ধু মিত্র ) নাটক-ই নয়, রূপচাঁদ পক্ষীও একজন কলকাতার লিপিকার।
আবার স্টীম ইঞ্জিনের আবিষ্কার ও সাফল্য ও তাঁর গানে ধরা দিয়েছে - - - -
অগ্নি জল আর পবনে
যায় এক মাসের পথ একটি দিনে
নবমী নিশি পোহাইল'- এর মত বিজয়াগানের পাশেই আমরা একাধিকবার তাঁর গানে শ্রীরাধাকে পেয়েছি। যখন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরার রাজা হয়ে রাধাকে ভুলে গেছে, তখনই শ্রীরাধিকা তার বিলাপগানে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেছেন - - -
লম্পট শঠের ফরচুন খুললো,
মথুরাতে কিং হলো,
আঙ্কেল কংসের প্রাণ নাশিল,
কুব্জার কুঁজপেল ডালি।
এই গান কোন বৈষ্ণবীয় ভাবোচিত মাথুর পর্যায়ের গান নয়। এখানে 'কৃষ্ণ' হল মহারাজা নন্দকুমার, যাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় এবং কুব্জারা হল সোনাগাছী, হাড়কাটা গলির বাররণিতারা যারা বাবুদের বদান্যতায় 'ধববিবি' হয়ে ওঠে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মত যে আজকের মধ্যবিত্ত বাঙালী মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলে যেভাবে ইংরেজি অভ্যাসে কেতাদুরস্ত প্রমান করছে নিজেদের, তাদেরই প্রতি বিদ্রূপ ঝরে পড়েছে রূপচাঁদ পক্ষীর গানে। বর্তমানে এই পক্ষীসম্প্রদাযে়র কথা অনেকেরই অজানা, কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহের নকশার সমমর্যাদাসম্পন্ন এই আখড়াই সঙ্গীত অবশ্যই সাংস্কৃতিক ইতিহাসের খনি।
■ তথ্যসূত্র :-
১) বাবু গৌরবের কলকাতা--বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়
২) ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা--যোগেশচন্দ্র বাগল
৩) কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা--মহেন্দ্রনাথ দত্ত
৪) বাঙালির গান--দুর্গাদাস লাহিড়ি
৫) 'বাবু' প্রবন্ধ--বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
সমীপেষু দাস |
No comments:
Post a Comment