এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

শ্যামাপদ মালাকার



কবিতা (সাধারণ বিভাগ)



দু'চোখ এঁকেছি

ভেজা শ্রাবণে গাঙে হতাশার গতি নিয়ে
ভীড়ে যবে জাল পদ্মার কূলে--
হঠাৎ ডুকরে ওঠা নয়ন দেখেছি,- অমনি-
আকাশের গায়ে চোখ পেতে
করুণ আবেদন, "তারে" ভাবায়- -

কখন ধবলির পিছে খরা-অন্তর দাহ করে ফিরে বিচুলির প্রাঙ্গণে, চেয়ে রয়- - - অপুষ্টি ভেজা খোকার পানে- -
কত বার যে ভাসে নিয়তির নীরে
তবু পুষেরাখে সবুজ তরুটি অপাঙ্গে।

নিথর-নিঃসাড় সেই দু'টি চোখ আমি এঁকেছি--"পল্লীমায়ের প্রশস্ত ললাট নীচে!"।




আহ্বান

চুমিয়া নিখিল দিবারুণ জ্যোতি হইল রে অবসান-
পল্লীর দেহে হাঁকিছে বিজন ঝিল্লির ঝি - ঝি গান।
কূলে আন তরী ওরে ভাই মাঝি ভরা শ্রাবণের গাঙ-
ওপারের গাঁ'য়ে ফুঁকিয়া শঙ্খ পাকাইছে ঘন সাঁঝ।
শোন ওরে সব বিহগেরি রব নদীতীর বিরাজিত-
ভাঙ্গিয়া দু'কূল বহে তরুমূল হয়ে সব পরাজিত।
ধরণীর হিয়া হইছে পিছল গুমুরিছে গুরু বারি-
এখন ভীষণ ঘোষেণ সমর দূর্দম বেগবতী।

ফিরে আয় ওরে ত্যাজিয়া নিখিল বহিয়াছে তিলে ক্ষণ-
পথবাঁকে দীপ চাহিয়াছে কার ঝরিয়াছে দু'নয়ন!
আজ নয় শুধু বাঁচিলে পরাণ ফেলিতে হবে রে জাল-
ধরণীর দেহে বাহিয়া তরণী ধরিতে হবে রে হাল!।





মুক্ত গদ‍্য


দিদির দ্বিতীয় পত্র

দিদির প্রথম পত্র পাওয়ার পর অনেক কাল উনার কোনো সংবাদ পাইনি। সংবাদ পাইনি বলে যে দিদির  সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কের অভাব গড়ে উঠেছিল তা নয়,
দু'জন দুইমেরুতে থাকলেও- আমাদের সম্বন্ধ ছিল নিত্য।
কিন্তু আমি এমনেই এক হতভাগা,- দিদির সাক্ষাত লাভ হতে চিরকাল বঞ্চিত রইলাম!
শুনেছি, তিনি নাকি এক অভূতপূর্ব রুপের ছটা নিয়ে সিদাগ্রামে এসেছিলেন। এটাও শুনেছি, উনি সিদাবাসী এক নব যুবার প্রতি গভীর প্রণয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
এক অনন্ত রুপরাশির ছটা-- দুই প্রণয়াবদ্ধকে অবলম্বন করে গ্রামস্থ সকল কামিনীগণও উানার- চরমতম শত্রু হয়ে উঠেছিল।

যাই হোক, তিনি আমায় দূর থেকে দেখে কেমন করে চিনে নিয়েছিলেন, তা আমি আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।

- আর বিলম্ব না করে,-- দিদি দ্বিতীয় পত্র যে আমাকেই লিখে গিয়েছেন, তা আমি লোখমুখে টের পেয়েছিলাম। সেই পত্রের কথায় আজ আমি ব্যক্ত করতে চলেছি। যা উনার মৃত্যুর কয়েক মুহুর্ত আগে --আমার বন্ধুু- অচিন্তর হাতে সেই চিঠি তুলে দিয়ে গেছেন । পরবর্তী ক্ষেত্র খবর পেয়ে আমি, বন্ধুর নিকট হতে সেই পত্র উদ্ধার করি।



ভাই শ্যাম,
               এই বিবেচনা করিও না, যে দিদি অনেক কাল পর স্মরণ করেছে তোমায়।
বেশী কিছু বলবো না--, না পড়ে অধিক ভেবে দিদির অন্তরের কথা কখনো ত্যাগ করো না।
তুমি আমার জীবনে সত্য,-- তাই দুটো কথা বলে যাব ভেবেই- তোমাকে আজ এই পত্র লিখতে বসা।

পূর্বে উদিত নিত্য অরুণীর ন্যায়- এই রুঢ়া-রসহীনা সিদার বুকে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই আমার জীবন কাটছিল।
আমি কখন ভাবিনি-- এই হতবাক হতশ্রী 'সিদা' কোনোকালে আমার বসবাসের উপযোগিনী হয়ে উঠবে।
সর্বক্ষণ একটা স্তব্ধ পরিস্হিতি আমার চারিপাশে ঘুরে যেন বেড়াত।
মনে মনে ভাবতাম,-আমার বালিকা স্বভাব বলেই কি সকল বস্তু আমার সংস্পর্শে এমন স্বাদহীন হয়ে উঠছে! নাকি,--সকল বস্তুর স্বাদ ও গুণাগুনের সঠিক বিচার শক্তি আমার মধ্যে অনুপস্হিত? অর্থাৎ, এইরকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে আমার জীবনপ্রবাহ অবিচ্ছেদ্য ভাবে বয়ে চলছিল।

কিন্তু আমি আজও নিঃসাড়-নির্বাক! আমি কেন নিঃসাড় কেনই বা নির্বাক! তা তোমাকে ব্যক্ত করতে পারবোনা,
কারণ সেই শীর্ণাপল্লী সিদা- আমার মরমে যে লাজের বাঁধ বেঁধেছে তা শিশিরসিক্ত দূর্বার ন্যায়, মুখ তুলে আজও তার পানে চাইতে পারিনা।

সেদিন দেখলাম,--রক্তিমাভা ত্যাগ করে রবি যে পূর্ব হতে  অধিক তফাতে গিয়েছে তা নয়,- তফাৎ কিঞ্চিৎ, শুধু এইটুকু সময়ের ব্যধানে- - -আমি বড়ই চঞ্চল বড়ই অস্হির হয়ে উঠলাম!।
সেদিন আমি পরিষ্কার করে দেখেছিলাম, সমটা ছিল- শীতের শেষ বিদায়বার্তা ও বসন্তের আগমন বার্তার ঠিক মধ্যবর্তীক্ষণ। যখন সারাদিনের ক্লান্তি নিবারণার্থে রবি পশ্চিম দিগন্তে-- লাল আসনে বসবার লাগি সবেমাত্র উদ্যোগ করছে- সেই ক্ষণে গ্রামের নিকটস্হ- শুভ্র, অপ্রশস্ত দীর্ঘিকার তীরে গিয়ে বললাম।
অভ্যন্তরস্হে কান পেতে শুনলাম-- একটা সাজ সাজ রবের প্লাবন বয়ে চলেছে! কার সাজ - কিসের সাজ - কেই বা সাজবে! আমি লোভ নিবারণে অসমর্থ হয়ে, সাধ পুরণের জন্যে নিকটস্হ অন্তরাল হতে পুরোটাই দেখতে লাগলাম!।

দেখলাম-- আমার এই ক্ষীণাপল্লীর অন্তর মহলে অজস্র কক্ষে-- হীরক দীপ, ফটিক দীপ, রত্ন দীপ, আপন আপন গুণ প্রকাশ করে উজ্জ্বল এক আলো বিকীর্ণ করে চলেছে, আর সেই স্হলে, সকল শ্রেণীর বৃক্ষ এসে এক একটি কক্ষ অধিকার করে নিচ্ছে। কক্ষমধ্যে দাস-দাসীর সংখ্যাও কম নয়, ওরা মধ্যে মধ্যে কেউ কেউ আবার মুকুলিত তরুর শাখা প্রশাখায়- কেউ স্নিগ্ধবারি সিঞ্চন করছে, কেউ বা রজত দীপের সেক- কেউ বা গন্ধবারির ছটা, কেউ বা আবার তীব্র করছে- রত্ন দীপের শিখা!।
আজ কেউ কারু প্রতি চেয়ে আর দেখছে না, কারু প্রতি অভিযোগ তুলে মন ভারী করছে না,-- আজ দেহ যত্ন করার দিন- আজ দেহে গন্ধবারি ছিটাবার দিন,- সবাই আপনার ভাবে বিকশিত - আপনার লাজে মুকুলিত, আজ সবাই সকলের প্রতি চেয়ে নিজ নিজ অঙ্গরসের গন্ধে টল-টলায়মান ঢল-ঢলায়মান!।

সকল কক্ষান্তর বাহিত- রুপ, রস, গন্ধ, বর্ণ একত্রিত হয়ে কক্ষসংলগ্ন দীর্ঘ প্রাঙ্গণ এক রাম-ধণুর ন্যায় অনন্ত তরঙ্গের সৃষ্টি হতে লাগল।
এই রহস্য বিন্দুমাত্র আমি উপলব্ধি করতে পারলাম না। তাছাড়া কেনই বা সকল বৃক্ষলতাদি অনন্ত রঙ্গরসে মেতে উঠেছে! আমি আরো নিকটে গেলাম। গিয়ে, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কিছু কথোপকথন শুনতে লাগলাম।
কেউ বলল,--"এইবার আমি অধিক পুষ্পিতা হবো।" কেউ বলল,--"আমার দেহে আর একটু রঙ ছড়ায়ে দাও।" কেউ বলল,--"অধিক পুষ্পিতা হয়ে কাজ নেই, অন্তর শুকিয়ে যাবে!"।
আমি আর বিলম্ব করলাম না, সকল দর্শনই আমার নিকট অপরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল। তাই রঙে-রসে-লাজে রাঙা এক মল্লিকাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,--"ভাই, আমি তোমাদের কাজ কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা, এই সকল কর্ম কি? এবং কেনই বা করছো কার জন্যে করছো,-তা যদি অল্প কথায় প্রকাশ করো-- বড় প্রীতা হবো।"

সে বলল,--"আজ তো আমাদের শাখা-প্রশাখা যত্ন করার দিন, যত্ন না করলে- বসন্তে তার সম্মুখে মুখ দেখাবো কি  করে?"।
আমি সেদিন বলেছিলাম--"'তারে' মুখ দেখায় বা তোমাদের লাভ কি হবে?"
সে বলল,--"বা! দেহ সুন্দর করে বিকশিত না করলে-- যদি সে আমায় ত্যাগ করে!"।
সেদিন একথার অর্থ না বুঝলেও, শব্দটা অন্তরস্হল পর্যন্ত ধ্বনিত হয়েছিল! সে কথার অর্থ আমি আজ বুঝেছি, আজ আমিও সেজেছি- সাজতে শিখেছি- সাজাতেও শিখেছি।
এখন শুধু একটাই ভয়- ভাল করে সেজে- দেহ বেশ করতে না পারলে সে যদি আমায় ত্যাগ করে!
যেদিন প্রথম সাজ সেজে শুধু তার জন্যে ঘরের বাইরে এলাম- সেদিন হতে আমার সাজবার কারণ খুঁজে, বড় বড় সমাজ পতিরা সমালোচনার ঢেউয়ে সমস্ত গ্রামকে একত্রিত করতে লাগলেন। সেদিন কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে-- সকল সমালোচনার ঢেউ দু'পায়ে মাড়িয়ে নব নব সাজে সেজে শুধু চরণে মরার বাসনা রাখলাম।
সেদিন হতে আজ পর্যন্ত যে পথে হেঁটে চলেছি- তার অনেকখানি পথ অতিক্রম করে ফেলেছি।

লোকমুখে শুনে আসছি-"ভালবেসে ঘর বাঁধলে নাকি সুখের মাত্র কমে যায়!"
সেদিন হয়তো পারবোনা তরুর ন্যায়--শাখা-প্রশাখায় রঙ লেপে গা'-গতর সুন্দর করতে।
সেদিন নিশ্চিৎ সে আমায় ত্যাগ করবে জানি।  যাকে নিয়ে এতকাল মরেছি, তাকে ছাড়া আর বাঁচতে চাইনা।
আমি জানি,- সে আমায় ত্যাগ করলেও-- "সে" আমায় কখন ত্যাগ করবেনা!

তাই মরার আগে তোমাকে দুটো কথা বলে যায় ভাই, সেদিন তাকে বলিও,--" দিদি যতবার সাজিয়াছে- শুধু তোমারি জন্য-- দিদি যতবার হাঁসিয়াছে শুধু তোমারি জন্য!"

মৃত্যুর সময় তোমাদের কাছে পাবোনা, শুধু মনে করো,-"মৃত্যুর পূর্বে দিদি হয়তো-- হিরাপুর শিয়রে ঢলিত সপ্তর্ষির প্রতি একবার নিবিড় ভাবে চেয়েছিল!"।।

দিদি


শ্যামাপদ মালাকার

No comments:

Post a Comment