এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

আশির ব্রত চৌধুরী



সিরিজ কবিতা (ধারাবাহিক)




লোককাব্য --৭৩(১)
**************

কেঁদে কেঁদে ঘরে ফিরে নিমজ্জিত শৈশব গোধূলী
ফসলের ক্ষেতে নামে গুপ্তচাঁদ অখণ্ড প্রহর
শরীরে আগুন লেগে ধোঁয়া থেকে স্মৃতির কুণ্ডলী
অভাব শরীর থেকে দানা খুঁটে পাখির নখর।

নিদারুণ কষ্ট নিয়ে নিভে যায় ফুলের মাসিক
বয়স শরীরে গিলে ছাতা থেকে ঝরে যায় শিক
সুখের পতাকা নিয়ে ছেঁড়াদ্বীপে নেমেছে আকাশ
ঘুমের চিতার মাঝে অগ্নি থেকে জেগে উঠে লাশ।

কতদিন কতরাত কান্নাজল সাগরেতে মেশে
জন্ম থেকে হেরে গেছে শরীরের নিকষ পাথর
তবুও গলায় বাঁধে প্রস্ফুটিত গোলাপ সময়
কেউ কেউ জেনে ফেলে রাতে নামে কোথায় সাগর।

চাঁদ থেকে নিভে যায় মাঝেমাঝে আনন্দ সকাল
সুখের সীমানা নিয়ে বসে থাকে রঙিন প্রবাল।





লোককাব্য - ৭৩(২)
**************

নিষিদ্ধ দরজার পাশে জেগে থাকে নিস্তব্ধ প্রহরী
শরীর ফসল ভেবে ডুবে যায় আদ্যপ্রান্ত নখ
সূর্য্যের জিহ্বায় চেটে ফেরীঘাট ডুবে একেবারে
একাকী নিরবে হাঁটে তলোয়ারে ঝুলন্ত মস্তক।

কোথায় ফুটাবে বিষ চেয়ে দেখে সাপের মগজ
কপাটে করুণ সুর চেয়ে নেয় সময়ের দেনা
শরীরে প্রচণ্ড রোদ তবু কাঁপে প্রবল জোয়ার
আয়নায় নিজেকে দেখে ভুলে যায় ভুল বেচাকেনা।

কি করে বুঝানো যায় সময় আসলে উড়াধুরা
তবুও কখনও জাগে সুর হয়ে প্রনয় প্রলাপ
কষ্টের অক্ষরে থাকে। না বলা, শব্দের উড়াউড়ি
গলার শিরায় কাঁদে চুরি করা হারানো সংলাপ।

মানুষের গন্ধ থেকে চেনা যায় ভীড়ের শরীর
কান্না হয়ে ছুটে আসে একলব্যের সকরুণ তীর।




লোককাব্য - ৭২
**************

এবার সত্যিই যাবে সাগরের অনন্ত ভাসান
কতজন এরই জন্য মন থেকে খুলে ফেলে দূর
আনন্দ লুকিয়ে রাখে গতায়ু রোদের কিছু চারা
রাত্রি থেকে নেমে আসে ডুবোচরে স্রোতের সিঁদুর।

তবুও স্রোতের গায়ে আনন্দ রঙের কিছু ভুল
গভীরের ইচ্ছে থেকে কপোতীর রঙ হয় চুরি
নিজেকে ঠকিয়ে রোজ মুঠো থেকে চুরি করে হাত
সীমিত সীমানা নিয়ে মহাকাশে দুঃখী কিছু ঘুড়ি।

অফুরান ঘুম নিয়ে জেগে থাকে হাঁসের বিষাদ
শূন্য  অক্ষে ডুবে যায়।  অকালে সুখের অটোগ্রাফ
রঙধনু চিনে ফেলে পৃথিবীর দুঃখের শরীর
ত্রিফলার নিম্নবুকে অপরাধে কাঁদে কিছু পাপ।

তবুও প্রলাপ লিখে পুকুরেতে চাঁদ ডুবে রাত
ছাতিম শ্মশান থেকে নেমে আসে অকাল প্রভাত।




লোককাব্য ---৭১
**********

কেঁপে উঠে ব্রহ্মতালু ভেসে যায় আদিম যমুনা
প্রাচীন বালক আমি গন্ধ দিয়ে কবিতা সাজাই
বাতাস শুকিয়ে গেলে রোদের শরীর ধরে কাঁদি
বুকের করাত দিয়ে চাঁদ থেকে স্মৃতি পেড়ে খাই।

নিজেকে বেঁচার জন্য স্বপ্নের সদরে বিজ্ঞাপন
আনন্দ নির্বাণ নিলে প্রস্রবণে কুসুম বাতাস
বুকেতে লুকিয়ে রাখি আনন্দের আনন্দলহরি
আমি আর কত জানি সন্ধিস্থলে লুকানো প্রশ্বাস!

কোথায় হারিয়ে যায় ফসলের কবিতার খাতা
কতজন জানতে পারে মন হলো আলাদা প্রত্যয়
দুঃখ নিয়ে উড়ে যায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর শরীর
অশ্রুর গভীর ভীড়ে জল আর কতটুকু সয়।

কখনও গোপন করি সূর্য থেকে হারানো আলোক
আয়নায় লুকানো থাকে প্রত্যেকের হারানো অশোক।
দীঘির সীমানা জানে বৃত্তের গভীরে কত  জল
রাতের শরীর থেকে খসে যায় নীল অনুপল।



লোককাব্য -৭০
************

সময় নিবিষ্ট হলে বদলে যায় পাখিদের তান
গোপনে একাকী ভাসে স্থিরচিত্রে জলেদের মীর
শুধু শুধু শূন্যে ওড়ে লক্ষ্যহীন গাণ্ডীবের তীর
জলের গভীর নীচে শোনা যায় পৃথিবীর গান।

চাঁদকে গোপনে ধরে একা গায় কিশোর লহরী
গভীর বিষাদে কাঁদে রজঃহীন অন্ধ বিষহরি
বিপুল খরার দিনে মাটি আঁকে নিজ প্রতিকৃতি
যে গাছ পলাশ হবে তার সাথে থেকে যাবে স্মৃতি।

অন্ধকারে নেমে আসে ভুলে যাওয়া গাছের শরীর
বিশাল ছায়ার হাতে চুরি হয় শৈশব দেয়াল
কেউ কেউ চেষ্টা করে সাগরের বুকে দিতে আল
অন্ধকার গিলে নেয় মধ্যবুকে প্রাচীন প্রবীর।

গলায় লুকানো থাকে ক্ষতসহ অন্ধ তরবারি
বাউল অন্তর বুনে ক্ষতের গভীরে শুকসারি।





লোককাব্য -৬৯
*************

পুরোনো ব্যথার রাত জাল ফেলে পুকুরের জলে
তুলে আনে গভীরের দগ্ধনীল বক্ররেখা মুখ
পৃথিবীর কোন বাঁকে হারিয়েছে সোনালি অসুখ!
সুখের সাগর খোঁজে রাতের আকাশ পরিমলে।

অনেক গভীর ক্ষত। লগি মাপে ক্ষতের গভীর
পৃথিবীতে মরে যায় নামহীন অমিয় সন্তান
সূর্যের ছায়াকে আঁকে চঁড়ুইয়ের ছোট্ট ছানাখান
শুকানো স্তনের মত ভেঙে যায় নদীদের তীর।

পৃথিবীতে আজও ঘুরে যজ্ঞের অশ্বের শ্বেত ঘোড়া
কোজাগরী জোছনা দেখা আসামীর চক্ষুখান মোড়া।
অক্ষর ভীষণ দোষী ছোট্ট এক বিষের বোতল
একবার ঢুকে গেলে অন্ধকার প্রাচীন মহল।

শ্বাসটুকু টেনে নিয়ে দুঃখটুকু চেপে রাখে হাতে
মৃত্যুর কৌশল নিয়ে চিতাকাঠ ডাক দেয় রাতে।




লোককাব্য-৬৮
*************

এত যে কবিতা লিখি নিষিক্ত বীজের আগমনী
নাভিকুণ্ডে জেগে ওঠে চিতাকাঠ বসন্ত বাতাস
কোনোদিন কেঁদে ওঠে ধ্বংসস্তূপে জ্যান্ত এপিটাফ
বাতাসে দুয়ার টেনে বেঁচে থাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস।

দেয়ালে ঝুলন্ত ছবি আয়ুছাড়া দীর্ঘদিন বাঁচে
সমস্ত পৃথিবী জানে চূড়া থেকে ঝরে গেছে রাই
পাখিদের স্তন থেকে খুলে পড়ে রাতের আলাপ
শব্দের শরীর দিয়ে গাছে গাছে করুণ ফলাই।

মুঠোর গভীরে থাকে জীবনের বিগত যৌবন
কোন ছলে কেড়ে নেয় পৃথিবীর ডুবন্ত শিকারী?
হাসি নিয়ে বেঁচে থাকে বেপাড়ায় দুঃখের মৌসুম
নিজের ছবিকে দিয়ে তৈরি করে গুপ্ত চাঁদমারি।

দুধদাঁত ঝরে গেলে হাসি থেকে চুয়ে পড়ে ভোর
নাবাল কিশোর জানে কখন ভাঙবেই ঘরদোর।





লোককাব্য-৬৭
*************

কথাজন্ম মরে গেলে স্বপ্ন থেকে খুলে যায় ঘুম
গভীর বিষাদে আজ নদী টানে পাহাড়ের বিষ
তবুও নীলাভ ডিমে বেঘোরে ঘুমায় কত শীস
ফুসফুসে পাখিরা গায় ধারাপাত একাকী নিঝুম।

নিষিদ্ধ যাপন আঁকে দাগ কেটে বন্ধ চোরাগলি
ফসলের গান লিখে বৈরাগীর আনন্দলহরি
হাসির খোলস দিয়ে কান্না গাঁথে অন্ধ বিভাবরী
কৈবর্ত সকাল গায় কথকের ছিন্ন পদাবলী।

একতারা ফেলে দেয় সহজিয়া মাটির বৈষ্ণব
মাটির আঁচল জানে কাদার গভীরে কত মায়া
কে আর এতটা বুঝে শীর্ষপত্র গড়ে কত ছায়া!
নিজের শীতল বুকে বাস করে উষ্ণ অনুভব।

চুমোর গরলে ঢাকে নিবিষ্ট চাঁদের অহংকার
নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে শূন্যে লিখে শান্ত হাহাকার।



লোককাব্য - ৬৬
**************

শূন্যের ভেতরে থাকে আলোর গোপন জন্মফল
ফাঁসের রশিতে ঝুলে মরে যায় ইঁদুরের কল
যতই গভীরে যাই হাতে ওঠে বিষের কলস
পাহাড়ের ঘাই লেগে মেঘের শরীরে নামে ধস।

রাশিফলে ব্যর্থ আয়ু ষটচক্রে আকুলিবিকুলি
গভীর সঙ্গম শেষে কেঁদে ওঠে আকাশ গোধূলী
স্রোতের মায়ায় পড়ে ডুবে যায় চাঁদের বাগান
গর্ভকুণ্ডে জেগে ওঠে সূর্যের হলুদ শাড়িখান।

সাপের ঠোঁটেতে থাকে জন্ম থেকে বিষের বাগান
দুঃখের অমৃত গায় ভোরবেলা রাতের প্রহরী
হাতের মুঠোতে থাকে সুখের কোমল আশাবরী
মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে গালের গোপন তিলখান।

নীরবে নিভিয়ে ফেলে শব্দের করুণ চন্দ্রাবলী
আকাশ জ্বালিয়ে রেখে নিজের নদীতে ফেলে পলি।




লোককাব্য -৬৫
*************

বালির গভীর বুকে বয়ে যায় অনন্ত সলিল
কোথায় লুকিয়ে রাখে গুপ্তজল মরুর পাথর?
নদীই প্রসব করে বুকের অনন্ত বালুচর
আকাশে অক্ষর খোঁজে গৃহহীন নীল আবাবিল।

শব্দের চোখের নীচে আয়ুরেখা বাস করে কার?
কষ্টের বাকল টেনে চিরকাল সময় বামন
পাখির উড়াল ঠোঁট ছুঁয়ে যায় সুদূরের মন
কে আর অতল খোঁজে? কঙ্কালে কতই হাহাকার।

গাছের ছালের নীচে বেঘোরে ঘুমায় মায়াজল
প্রশাখার ডাল শেখে প্রতিবন্ধী হাতের কৌশল
চোখের মনির তীড়ে গর্ভছেঁড়া সময়ের ফাল
অভিশাপ গিলে খায় স্মৃতিদের পুরোনো দেয়াল।

সময়ের তীর থেকে হাঁক ছাড়ে উদাসী বাউল
রাধার গভীরে আঁকি আস্ত এক বিরহ গোকুল।





লোককাব্য -৬৪
*************

দুয়ারে ভিক্ষার ঝুলি ঘর ছাড়ে চারন যুবক
বুকের করাত কলে ছিন্ন করে সব অভিমান
শালিকের ঘরে রাখে গোধূলির নিঃশব্দের গান
সুগন্ধি স্তনের মুখে কার যেন ঠোঁটের নোলক?

কালের চোখের মিরে বিষ ঢালে সাপের ছোবল
রাত থেকে খুলে নেয় শূন্যতার অসীম ভেতর
অসীম দেনায় ভাসে  লুকায়িত পৃথিবীর চর
সারসের ঠোঁট খোঁজে কোথায় রেখেছে এত ছল।

রাধার চোখের ঘোর কীর্তিনাশা সময় অতীত
মাটি আর কত লিখে সময়ের চরিতাবিধান!
রাতের পঞ্চমগুলো শিরার গভীরে মারে টান
স্রোতের খরায় কাঁদে উদাসী ভিক্ষুক উপবীত।

চাঁদের গভীরে মায়া বাসন্তী রঙের স্বপ্নগুলো
নদীর সূতিকা রোগে চরায় জমেছে আজ ধুলো।




লোককাব্য- ৬৩
**************

বৃষ্টিতে আগুন লেগে নিভে যায় স্তব্ধ চরাচর
অনন্ত অক্ষর নিয়ে পাড় থেকে খুলে যায় শাড়ি
রূপকথা সাক্ষী রেখে গল্প বুনে অন্ধ শুকসারি
নিগূঢ় বৈরাগ্য এলে পাথরের গায়ে আসে জ্বর।

সময়ের চোখে ঘোর মেনে নেয় অকাল নির্বাণ
শরীরের কান্না থেকে খুলে যায় সন্ধি ও সমাস
চাঁদের চৈতন্য বুনে শব্দের প্রগাঢ় অনুপ্রাস
খালের মান্দার কাটি আমি ও অনন্ত রাত্রিখান।

পর্দার জানালা খোলা লেখা আছে প্রবেশ নিষেধ
বিষের বৈধব্য খুঁজে সাপের জিবের ভেদাভেদ
চরায় মাস্তুল কোপে উড়ে যায় দুরন্ত নিশান
বুঝার ত্রিভূজ থেকে ছেঁটে ফেলে শেষ অঙ্কখান।





লোককাব্য - ৬২
**************

এবার ভাসুক ডিঙা স্রোতের গভীরে যতদূর
মুদ্রায় অক্ষর লেখা ভাসানো শব্দের অন্তর্জলী
মেঝেতে ধ্রুবক এঁকে চারপাশে ছিন্ন শব্দাবলী
লোহার বাসর থেকে জেগে ওঠে শব্দের অঙ্কুর।

রোদের জিভের রক্তে প্রজাপতি হয়ে উঠে মথ
জীবন ক্রমশ বাড়ে আয়ু থেকে ছেঁটে যায় দিন
কে কার রক্ষক আজ? ছিদ্র থেকে ঝরে গেছে বীণ
ছড়ানো প্রান্তর থেকে খুঁজে যায় অজস্র বেপথ।

গোপন অক্ষর খুঁজে অনাবাদী পতিত জমিন
চোখের শমিক বৃক্ষ সলিলের ভারে অন্তলীন
গভীর অদেখা হলে রক্ত থেকে হয়ে যায় কুঁড়ি
রাতের শরীর থেকে অন্ধকার হয়ে গেছে চুরি।





লোককাব্য- ৬১
*************

জোয়ার প্রবাহ থেকে ডুব দেয় জোছ্নার পূর্ণিমা
রাত্রিতে এখানে নামে মুটো ভরা শব্দের কঙ্কাল
নারীর জরায়ু ফেটে যেন নামে অবোধ ছাবাল
প্রতিরাতে বদলে দেয় নূপুরের ঘুমের ভঙ্গিমা?

দূর থেকে কারা আনে অবিরাম কাকসুর ভোর?
গাছেদের পেট হলে ভেঙে যায় স্বপ্নের বেঘোর
সময় বাড়ন্ত হলে নিয়তির বৃদ্ধ এক ডাল
ভূমিতে ঈশ্বর নামে। হাঁক ছাঁড়ে আকাল আকাল।

তোমার বিষের থলি সময়ের কতখানি ধার?
ভাটির বাতাস হলে টেনে নেয় হাত থেকে দাঁড়
মাছেরা গাভীন হলে হাতের তালুতে মারে ঘাই
সমূহ আকাল খেয়ে গায়ে বাড়ে আমাদের রাই।



লোককাব্য - ৬০
**************

অবশ লেগেছে গায়ে নেমে গেছে পুরাতন গাছ
যে নদী ঘুমিয়ে গেছে স্তনে তার বিরহের বাঁক
গোপন লুকিয়ে গেলে পাথরের গায়ে দেয় আঁক
হতাশ মাঝির হাত। খুঁজে ডাঙা। আর নীল কাঁচ।

সওদা করে ঘরে ফিরে বিরহের রঙীন কাঙাল
বৃষ্টিতে শুকাতে দেয় জীবনের সমূহ চাদর
তীরবেঁধা পাখি খুঁজে। অন্ধকারে কোথায় কাতর?
হারানো লাঙল থেকে জেগে ওঠে পুরাতন ফাল।

দেখা হবে কোনোদিন নৈঃশব্দের ফলিত আকাশ
পেয়ে যাবো কোনোদিন ঋতুবতী পাখির পালক
জলের কান্নার মাঝে দেখে যাবো হরিণীর শখ
শূন্যকে জড়িয়ে ধরে কারা করে সুপ্ত বসবাস।


আশির ব্রত চৌধুরী



No comments:

Post a Comment