মুক্তগদ্য
ইমেলার সফর অতীত থেকে বর্তমানঃ
বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণ ছিল এখন হয়েছে চোদ্দ পার্বণ। সেই চতুর্দশ পার্বনটি যে এই বইমেলা, সে নিয়ে কিন্তু কোনো তর্ক নেই৷ আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার মেনে যে মেলার শুরু হয় জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের বুধবার৷ ময়দানের খোলা মাঠ থেকে মিলনমেলার বাঁধানো চত্বরে ঠাঁইনাড়া আগেই হয়েছিল, কিন্তু এবার চেহারা আর চালচলনও বদলে যাচ্ছে কলকাতা বইমেলার।
২০১৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার এবার একটা পরিকাঠামোগত অসুবিধা হয়েছে শুরুতেই৷ ইএম বাইপাসের ধারে যে মিলনমেলা প্রাঙ্গনে বইমেলা বসে, সেখানে তিন দিন আগেই শেষ হয়েছিল রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ‘ডেস্টিনেশন বেঙ্গল' শীর্ষক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলন৷ তার জন্য মেলার মাঠে অতিরিক্ত একাধিক অতিকায় অস্থায়ী ‘হ্যাঙ্গার' তৈরি হয়েছিল, যেগুলো দু'দিনের মধ্যে খুলে ফেলে মিলনমেলাকে তার ফাঁকা জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া কার্যত সম্ভব ছিল না৷ ফলে রাজ্য সরকার এবং বইমেলার উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বইমেলায় যেসব ছোট স্টল হয়, সেগুলোকে ঐ হ্যাঙ্গারের মধ্যে জায়গা দেওয়া হবে৷ ফলে এবার শুরু থেকেই একটা বদ্ধ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বইমেলায়, যার সঙ্গে কেউই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না
হ্যাঙ্গারের সাদা সিন্থেটিক আচ্ছাদন, তার নীচে খুপরি খুপরি বইয়ের স্টল, পায়ের নীচে ঘাসের বিকল্প সবুজ রঙের কার্পেট, বদ্ধ পরিবেশ – এটা কি আমাদের চেনা বইমেলা? ‘না, এটা আমাদের ভালো লাগার বইমেলা নয়৷ মানিয়ে নিতে সকলেরই অসুবিধে হচ্ছে৷ কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না এবার৷'।
সবথেকে বড় অভিযোগ হলো, বইমেলা তার চরিত্র হারিয়ে ফেলছে৷ ছোট বইয়ের দোকানকে ভরে ফেলা হলো হ্যাঙ্গারের মধ্যে, অথচ মেলায় খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি৷ মাছভাজা, কষা মাংস, তিব্বতি মোমো, এছাড়া চা-কফি তো আছেই৷ লেখক সমীর ঘোষ তাঁর ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছেন –--“ এবার মেলায় যাব না, কারণ খিদে পাচ্ছে না”! এই বছর মেলার অত্যন্ত বিরক্তিকর যেটা ছিল--- রাশি রাশি এঁটো কাগজের প্লেট, গ্লাস, খাবারের ফেলা অংশ মাড়িয়ে হাঁটা৷ খাবারের দোকানের সামনে চাকবাঁধা ভিড়৷ বইয়ের দোকানে ঢোকার রাস্তা ঢেকে গেছে এমন ভিড়৷ বহু লোককেই দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা স্রেফ খাবেন বলেই মেলায় এসেছেন! এছাড়াও মেলায় স্টলের নম্বরের কোনো মাথামুণ্ডু নেই! কিছুই সহজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ অনর্থক ঘুরতে হয়েছে৷
১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হয়। মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ অবধি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল। কলকাতার ডিসি হেডকোয়ার্টার্স অর্চিষ্মান ঘটক মাঠের ভাড়া মকুব করে দেন। প্রবেশদ্বারের নকশা অঙ্কণ করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। মেলা উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তদনীন্তন রাজ্যপাল এ. এল. ডায়াস। প্রথম মেলার সভাপতি ছিলেন ‘জিজ্ঞাসা প্রকাশনের’ কর্ণধার শ্রীশকুমার কুণ্ডা। গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি সুশীল মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় সরকার, প্রবীর দাশগুপ্ত, বিমল ধর প্রমুখ বিশিষ্ট প্রকাশকেরা মেলার আয়োজনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। প্রথম বইমেলায় কলকাতার সব প্রকাশক সংস্থা যোগ দেননি। তাঁদের অনেকেই মেলার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। তাই মেলার মাঠ ছোটো হলেও তা ভরতি হওয়ার মতো স্টল পাওয়া যায়নি। তখন এনবিটি একটি বিরাট অংশ জুড়ে বইয়ের প্রদর্শনী করে এবং রূপা অ্যান্ড কোম্পানি একটি বিরাট প্যাভিলিয়ন দেয়। কিন্তু এই বইমেলায় যথেষ্ট জনসমাগম হওয়ায় পরের বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বইমেলার আয়তনও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এই বইমেলা আয়োজনের সুবাদে সেই বছর নয়াদিল্লিতে বিশ্ব বইমেলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় গিল্ড এবং জিতে নেয় মাঝারি স্টলের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি।
১৯৭৭ সালে আয়োজিত দ্বিতীয় বইমেলায় ১,৯৬,০০০ দর্শকসমাগম হয়; বই বিক্রি হয় এক কোটি টাকারও বেশি। তবে বইমেলার যে বিপুল জনপ্রিয়তা আজ চোখে পড়ে, তার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে আয়োজিত তৃতীয় কলকাতা বইমেলা থেকে। এই বছর মোট ১১২টি প্রকাশক সংস্থা বইমেলায় অংশ নিয়েছিলেন। মেলা আয়োজিত হয়েছিল রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে ভিক্টোরিয়া-সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত বৃহদায়তন মাঠটিতে। ১৯৮৩ সালে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ২৮৫টি প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সংস্থা। ১৯৮৪ সালে মেলা আয়োজিত হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেবার অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা ছিল ৩৬৩। এই বছরই জেনেভার ইন্টারন্যাশানাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে বইমেলার আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে স্থান করে নেয় কলকাতা বইমেলা।
১৯৯৭ সাল কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। এই বছর বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স; থিম প্যাভিলিয়নটি সাজানো হয়েছিল প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের আদলে। বইমেলার উদ্বোধন করেছিলেন স্বনামধন্য ফরাসি সাহিত্যিক জাঁক দেরিদা। কিন্তু মেলা চলাকালীন একদিন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো মেলা অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায়। ফলে প্রচুর টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ঘটনার ভয়াবহতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন দর্শনার্থীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু সরকার ও উদ্যোক্তাদের তৎপরতায় তিন দিন পরেই আবার নতুন করে বইমেলা শুরু করা হয়। এরপর থেকেই মেলার মাঠে ধূমপান ও আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। খাবারের স্টলকে মূল মেলাপ্রাঙ্গণের এক কোণে স্থান দেওয়া হয়। অগ্নিকাণ্ডে সময় নিহত দর্শনার্থী যতীন শীলের স্মরণে প্রতি বছর মেলায় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীর পূর্বে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা ক্যালেন্ডার অণুসারে জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার সূচনা হয় কলকাতা পুস্তকমেলার। শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় রবিবার। সাধারণত বারো দিন ধরে চলে এই মেলা। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক ধর্মঘট বা অন্য কোনো কারণে মেলার স্বাভাবিক কর্মদিবস নষ্ট হলে নষ্ট দিনসংখ্যার হিসেবে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়ে থাকে।
বইমেলার বিক্রি প্রতিবছরই কিছু কিছু করে কমছে, কিন্তু এবার নোট সংকটের কারণে বিক্রি আরও কম৷ পুরনো নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং বাজারে যথেষ্ট নতুন নোট না থাকার কারণে ব্যাপক অসুবিধে হয়েছে। অনেক স্টলে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু অর্ধেক সময়ই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না৷ বার বার ‘ট্রানজাকশন ডিক্লাইন্ড' হচ্ছে, ক্রেতারা বিরক্ত হয়ে বই না কিনে চলে যাচ্ছেন৷
২৬ জানুয়ারি, সাধারণতন্ত্র দিবসের ছুটির দিনে প্রতিবার যেমন হয়, এবার সেটা হয়নি৷ সুযোগটা হাতছাড়া হয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের চক্করে আগের দিন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে বইমেলা শুরুই হয়েছে এবার ঐ ২৬ তারিখ৷
সব মিলিয়ে এবারের কলকাতা বইমেলা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ অনেক বেশি৷ এবার নতুন করে আক্ষেপ শোনা গেছে, ময়দানের মাঠে সেই পুরনো বইমেলা কত ভালো ছিল!
No comments:
Post a Comment