এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

অভিষেক মিত্র



গল্প



রমেশবাবুর রাক্ষস

আমার দারোগা জীবনের দীর্ঘ ছিল প্রায় তিরিশ বছর। এই তিরিশ বছরে অত কেস যে আমার হাতে এসেছে তার ইয়ত্তা নেই। সাধারণ ছিঁচকে চুরি থেকে খুন পর্যন্ত। কিন্তু এখন আর কোনটাই বিস্তারিত ভাবে মনে নেই। বয়সের দোষ আর কি। কোথায় যেন শুনে ছিলাম যে বয়সের সাথে মানুষের মস্তিস্কের কোষগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে, যার ফলে অনেক কিছুই মনে থাকে না। যদিও এই ব্যাপারের বিজ্ঞানসম্মত কোন ধারনা আমার নেই। যাই হোক, আসল কোথায় আসি। আমায় অনেকেই বিভিন্ন সময় জিজ্ঞেস করেছেন যে আমার জীবনে সব থেকে রোমহর্ষক কেস কোনটা? আমি কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন কেসের কথা বলেছি। কারন অনেক কেসই আছে যেটাকে রোমহর্ষক বলা যায়, তাই কোনটা বেশি 'রোমহর্ষক' সেটা আমি এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করতেন যে আমার জীবনে সবথেকে মজার কেস কোনটা, তাহলে আমি একটা কেসের কথাই সবাইকে বলতাম। কেসটা এতটাই সোজা আর হাস্যকর ছিল যে সেটার কথা প্রায় পুরটাই মনে আছে। তার একটা কারন অবিশ্যি আছে। এই গল্পটা আমি এতবার এত জনকে বলেছি যে প্রায় সবটাই ভালো করে মনে থেকে গেছে। আর যে ব্যাপারটা কাউকে বলিনি, সেটার কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। 
তখন আমার বয়স বছর তিরিশেক হবে। দু বছর কালনায় পোস্টিঙের পর আমার ট্র্যান্সফার হল কলকাতার কাছাকাছি বাটানগর নামক একটা ছোট্ট মফশলে। থানায় চার্জ নিয়ে প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে। কলকাতার কাছাকাছি হলেও জায়গাটা ভীষণ শান্ত প্রকৃতির। দু একটা ছিঁচকে চুরি আর পড়শিদের ঝামেলা ছাড়া তেমন কোন কেস আসেনি এই ক'দিনে। কেস নেই বলে ক্রিমিনালও নেই। তাই থানার লকআপটা বেশির ভাগ সময়ই খালি পড়ে থাকে। যদিও সেই নিয়ে আমার বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই। কেস নেই বলে কাজও সেরকম নেই। তাই বেশ আরামেই দিন কাটছিল। 
এইরকম একদিন সকালে থানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছি, এমন সময় একটা লোক দরজা দিয়ে মাথাটা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, "আসতে পারি, স্যার?" 
খবরের কাগজ মুখ তুলে বললাম, "আসুন।" 
লোকটা ঘরে ঢুকলে তার চেহার দেখে একটু হাসিই পেল। রোগা, বেঁটে, কটা কটা চখ,মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে। বয়স মনে হল পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ হবে। পরনে একটা ময়লা পাঞ্জাবী আর পাজামা। সামনের দুটো দাঁত একটু অস্বাভাবিক রকম বড়। চোখে একটা ডাটি ভাঙা চশমা আর হাতে একটা বড় বাট-ওয়ালা তাপ্পি মারা ছাতা। সব মিলিয়ে একটা দেখার মত চেহারা। 
ভদ্রলোক আমার টেবিলের সামনে এসে হাত দুটো জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, "পেন্নাম স্যার। আমার নাম সুদীপ মহাপাত্র।" লোকটার গলাটাও শোনার মত। ওর গলাটা ভীষণ রকমের মিহি। কোন প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের গলা যে এতটা মিহি হতে পারে সেটা আমার ধারনা ছিল না। 
"নমস্কার, বলুন কি দরকার?" 
এদিক ওদিকে একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর গলাটা যতটা সম্ভব নীচে নামানো যায়, ততটা নামিয়ে সে বলল, "আমি আসলে আপনাকে একটু সাবধান করে দিতে এসেছি, স্যার।" 
"কি ব্যাপারে?" 
"মানে, স্যার," আবার চারিদিকটা দেখে নিয়ে চেয়ারটা একটু এগিয়ে নিয়ে বলল, "আমি দেখেছি, স্যার।" 
"কি দেখেছেন আপনি?" 
"রাক্ষস। এখানে একটা রাক্ষস আছে স্যার। এটা কি আপনি জানেন?" 
কথাটা শুনে আমি হো হো করে হেঁসে উঠলাম। যদিও সুদীপ মহাপাত্র কথাটা খুব সিরিয়াসলিই বলেছিল।তারপর অনেক কষ্টে হাঁসি চেপে বললাম, "রাক্ষস?" 
ভদ্রলোক যেন আমার হাঁসিটাকে পাত্তাই দিল না। সে আবার বলল, "হাসবেন না স্যার। আমি দেখেছি।" 
"তা কিরকম দেখতে আপনার রাক্ষসকে। মূলোর মত দাঁত আর কুলোর মত কান?" 
ভদ্রলোক দাঁত বের করে মুখ দিয়ে একটা খিক খিক শব্দ করে হেঁসে বলল, "কি যে বলেন, স্যার। সে তো সেই ছেলেবেলার রাজা রানির গল্পের রাক্ষস।" তারপর আবার গম্ভীর হয়ে বলল, "সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কি ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য!" 
"তা বলুন, কিরকম সেই দৃশ্য?" 
"শুনুন তাহলে। আমি এখানে ওই গুমোরজলারখানে একটা বিড়ি কারখানায় কাজ করি। তাও ধরুন বছর দশেক হল। গত একমাস ধরে আমি একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছি। আমাদেরকারখানায় কিছু একটা আছে, বুঝলেন স্যার। আমি কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে না একটা আওয়াজ শুনতে পাই।" 
"কি রকম আওয়াজ?" বেশ মজাই লাগছিল গল্পটা শুনতে। বসে বসে বোর হওয়ার থেকে তো ভালো। 
"একটা গুনগুন...গুনগুন...শব্দ। ঠিক যেন মাছির আওয়াজ। আস্তে আস্তে সেটা বাড়তে থাকে। যেন হাজার হাজার মাছি একসাথে। প্রথম প্রথম আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না ব্যাপারটা কি। একবার ভাবলাম, আমার কানটাই হয়তো গণ্ডগোল করছে। গেলুম আমাদের বরুন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারবাবু ভালো করে দেখে টেখে বললেন, না কান তো ঠিকই আছে।"
ভদ্রলোক দম নেওয়ার জন্য একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, "এই রকমই চলছিল বুঝলেন। তারপর আমি সেটাকে দেখলাম।" শেষ কথাটা বেশ থমথমে গলায় বলল সুদীপ মহাপাত্র। 
আমি হাঁসি চেপে বললাম, "সেটা? সেটা কি? আপনার রাক্ষস?" 
"ঠিক কি, তা আমি বলতে পারব না। সেটা আলোয় লুকিয়ে থাকে আর অন্ধকার হলেই বেরোয়।" 
বললাম, "তা অন্ধকারে সেটাকে দেখেন কি করে?" 
আর মনে মনে ভাবলাম, 'এর মাথাটা পুর খারাপ। অন্ধকারে রাক্ষস দেখে। চমৎকার।' 
সুদীপ মহাপাত্র একটু গলা খাঁকরিয়ে বলল, "না মানে, অন্ধকারে আর কি করে দেখব বলুন। কিন্তু ছায়া দেখতে পাই। ছায়া যখন পড়ে, তখন দেখি ওই রাক্ষসটাকে।" 
আমি মাটিতে আমার ছায়াটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, "কি, এইখানে দেখতে পাচ্ছেন এই রক্ষসটাকে?" 
ভদ্রলোক মাথা হেঁট করে আবার সেই খিক খিক করে হেঁসে বলল, "না, না...এখানে কেন দেখব? এ তো আপনার ছায়া। আপনি কি আর রাক্ষস বলুন, যে আপনার ছায়ায় আমি ওটাকে দেখব? আমি তো ওটা দেখি শুধু রমেশবাবুর ছায়ায়।" 
"রমেশবাবু? সেটা আবার কে?" 
"এই যে বললাম না স্যার, রাক্ষস।" 
"আহা, সে তো বুঝলাম। কিন্তু এই রমেশবাবুর পরিচয়টা কি?" 
"ও, তাই বলুন। উনি আমাদের বিড়ি কারখানার মালিক।" 
"তা আপনি ওখানে বছর দশেক চাকরি করছেন?" 
"আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার।" 
"তা বছর দশেক চাকরি করছনে আর মাত্র এক মাস আগে জানলেন যে আপনার মালিক রাক্ষস?" 
"তা হবে কেন? আগে তো উনি মালিক ছিলেন না। আগের মালিক শচিনবাবুর কাছ থেকে এই এক মাস হল উনি কারখানাটা কিনে নিয়েছেন। আর তারপর থেকেই আমি আওয়াজটা শুনতে পাই।" 
"আপনার মতে এই রমেশবাবুই রাক্ষস?" 
"হ্যাঁ, স্যার।" 
"তা উনি আপনার কোন ক্ষতি করেছেন?" 
"না, তা করেন নি।" 
"তাহলে, হোক না রাক্ষস, আপনার কি?" 
"আমাই কি মানে?" বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল ভদ্রলোক। "ও মানুষ খুন করছে আর আপনি বলছেন আমার কি? এই নিয়ে পাঁচটা হল।" 
"খুন করছেন? কই আমার কাছে তো সে রকম কোন রিপোর্ট নেই। তবুও আমি দেখছি।" এই খুনের কথা শুনে আমিও একটু সিরিয়াস হয়ে গেলাম। একজন কন্সটেবেলকে ডাকলাম, "দাসবাবু, একটু শুনুন।" 
"আহা, আপনি কি করে খবর পাবেন এই খুনগুলোর?" 
"মানে?" 
"ওদের শরীর তো বেঁচে আছে।" 
"কি যাতা বলছেন?" আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে। 
"আপনি শুনুন না, স্যার। রমেশবাবু ওদের শরীর থেকে আত্মা বের করে নেয়।আমি বুঝতে পারি। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বলেন না। রমেশবাবু যাদের আত্মা নিয়েছেন, তাদের ব্যবহারও পালটে গেছে। আমি নিজে সাক্ষী স্যার। আপনি আমাদের বাঁচান। ওকে এরেস্ট করুন।" 
"আপনি যদি বলেন যে আপনার মনে হয় একজন রাক্ষস, তাহলে আপনার মাথার ডাক্তার দেখানো উচিৎ। সেই লোকটাকে এরেস্ট করা নয়।" 
সুদীপ মহাপাত্র যেন আমার কোথায় কানই দিল না। বলতে লাগল, "জানেন স্যার, কালকে উনি আমার এক বন্ধুর আত্মা নিয়ে নিয়েছেন। মেরে ফেলল ওকে। রমেশবাবুর ঘর থেকে বেরতেই আমি বুঝেছিলাম, যে ও আর নেই। শুধু শরীরটা আছে, আত্মা নেই। আর..." 
আমার আর সহ্য হল না এই পাগলের প্রলাপ। কন্সটেবেলকে ডেকে বললাম পাগলটাকে বাইরে নিয়ে যেতে। 
দুদিন পর থানায় গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে বেশ অবাকই হলাম। থানার লকআপে মাথা নিচু করে বসে আছে সুদীপ মহাপাত্র। একজন কন্সটেবেলকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, "এই পাগলটা আবার কি করল?" 
"খুন করেছে স্যার। তপন দত্ত বলে ওদেরই বিড়ি কারখানার একটা মজদুরকে।" 
"কি?" আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। 
আমাকে দেখে হঠাৎ লকআপের ভিতর থেকে সুদীপ মহাপাত্র চেঁচিয়ে বলে উঠল, "আমি খুন করিনি, স্যার। ও তো তিন দিন আগেই মরে গিয়েছিল। আমি শুধু শরীরটাকে মুক্তি দিয়েছি।" 
"সাট আপ।" 
কন্সটেবেলের দিকে তাকিয়ে বললাম, "কনফেশানে সই করেছে?" 
"হ্যাঁ, স্যার। তবে সই না। টিপ সই।" 
"ওকে।" 
এই কেসটার ব্যাপারে আমি রমেশবাবুর সঙ্গেও দেখা করেছিলাম। ওনাকে দেখে মনে হল, যে উনি আর কিছু হন না হন, রাক্ষস হতে পারেন না। অত্যন্ত সাদা সিধা মানুষ। আর বিড়ি কারখানার বাকি মজদুররা কেউই ওনার সম্বন্ধে খারাপ কিছু বলল না। বরং জনা চারেক মজদুর তো ওনাকে প্রায় ভগবানই বলে ফেলল। 
এই কেসটা নিয়ে আমার এক মন বৈজ্ঞানিক বন্ধুর সাথেও কথা বলেছিলাম। ও বলে ছিল যে পৃথিবীতে এমন অনেক অসুখ আছে যার ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন ব্যাপার। ওর মতে সুদীপ কর্মকারের সাইকোকাইনেসিস ছিল। যার ফলে সে নিজে থেকেই এমন সব জিনিষ কল্পনা করতে লেগেছিল যে গুলোর আসলে কোন অস্তিত্বই নেই। কিন্তু ওর কাছে সেই সব জিনিষ সত্যি। ও সেগুলোকে দেখবে, সেগুলোর সাথে কথা বলবে। আসলে সবটাই ওর মনের ভুল। সুদীপ মহাপাত্র ভেবেছিল যে রমেশবাবুর মধ্যে একটা রাক্ষস আছে, যে মানুষের আত্মা চুরি করে। আর এই ধারনা থেকেই সে তপন দত্তকে খুন করে। ও আসলে মানসিক রোগী। 
এই ঘটনার প্রায় সাড়ে তিন মাস বাদে সুদীপ মহাপাত্র আজীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। কোর্টেও সে একই কথা চেঁচিয়ে বলেছিল, "আমি ওকে খুন করিনি। আমি ওকে মুক্তি দিয়েছি। ও তো আগেই মরে গেছিল।" জেল হওয়ার আগে যদিও ওর মানসিক পরীক্ষা করা হয়েছিল আর তাতে ও পাসও করেছিল। 
এই কেসটার কথা ভাবলে আজও মাঝে মাঝে হাঁসি পেয়ে জায়। কিন্তু যে একটা কথা কাউকে বলিনি, সেটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেও কিছু বুঝতে পারিনি। কেসটা একদম সোজা সাপটা ছিল। কিন্তু খটকা লাগল এক জায়গায়। 
তপন দত্ত যেদিন মারা যায়, সেদিন সন্ধ্যায় পোস্টমরটারম করার সময় পুলিশের ডাক্তার সান্যালবাবু আমায় ডেকে পাঠায়। আমাকে বেশ চিন্তিত ভাবে উনি বলেন, "আপনি সিওর যে এ লোকটা আজই মারা গেছে?" 
"হ্যাঁ। কেন বলুন তো?" বেশ অবাক হয়েই বললাম। 
ডাঃ সান্যাল ভ্রু কুঁচকে বললেন, "না, আসলে বডিটা এগজামিন করে মনে হচ্ছে যে এটা দিন তিনেকের পুরানো বডি। টাইম অফ ডেথ মনে হচ্ছে মিনিমাম বাহাত্তর ঘন্টা আগে। কি জানি আপনি যখন বলছেন তাহলে হয়তো আমারই কিছু ভুল হচ্ছে..." 
আমি যদিও এর পর ব্যক্তিগত ভাবে আরও খানিক তদন্ত করেছি, কিন্তু তাতে কোন ফল হয়নি। কিছু করেই আমি সুদীপ মহাপাত্রের কথার কোন প্রমাণ পাইনি।

অভিষেক মিত্র

No comments:

Post a Comment