এখন তরঙ্গ তে লেখা পাঠান প্রতিমাসের ৫ থেকে ২০ তারিখ অবধি

'এখন তরঙ্গ' (১৩)


প্রকাশকাল : ২২ এপ্রিল, ২০১৮

সম্পাদক : জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি





সর্বসত্ব সংরক্ষিত
তরঙ্গ পরিবারের পক্ষ থেকে
শাল‍্যদানী
Founder & Chairman,
Taranga House



                              
সূচীপত্র


■ কবিতা : পায়েল পাসোয়ান, অন্তরা চ্যাটার্জী, মধুমিতা মজুমদার, দীপ মন্ডল, জয়ন্ত দত্ত, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, আরিফুর রহমান, সুস্মিতা পাল, শ্রীকনা সরকার, স্বাতী নাথ, শ্রেয়ণ, ভজন দত্ত, পার্থ সরকার, সোহিনী সামন্ত, নাফছি জাহান, মোনামী মন্ডল, পৌলমী গুহ, সুপর্ণা ঘোষ, পারমিতা ঘোষ, তৈমুর খান, জয়জিৎ রীত, সৌরভ বর্ধন, সোমের কৌমুদী, মৃত্যুঞ্জয় রায়, সুমনা পাল ভট্টাচার্য, শুভনীতা মিত্র, সৌমী ঘোষ, সবর্না চট্টোপাধ্যায়, শম্পা মাহাতো, উজান উপাধ্যায়, তীর্ষু অধিকারী, সোনালী মিত্র, বিজন বিশ্বাস, অmrita, শৈবাল পাল, শ্যামাপদ মালাকার, আর্যতীর্থ, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় রায়, পারমিতা চক্রবর্ত্তী, শান্তা কর রায়, এলা বোস, বিশ্বজিৎ লায়েক, কৃষ্ণেন্দু দাসঠাকুর, লিটন আব্বাস, অহনা সরকার, স্মৃতি রায়, সোনালী মন্ডল আইচ, বিশ্বরূপ বিশ্বাস, সুদীপ ব্যানার্জী, মন্দিরা  ঘোষ, নন্দিনী সাহা, পারমিতা ঘোষ (পারমিতা বলছি), ডঃ মীনা মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত মাইতি, অনন্য বন্দ্যোপাধ্যায়, সুতনু হালদার, অসীম মালিক, জ্যোতির্ময় রায়, শুভদীপ পাপলু, নাসির ওয়াদেন, চন্দ্রানী পাল, আরিয়ান প্রিয়স, পৃথা রায় চৌধুরী, অনিরুদ্ধ সেন, সোহম হাটুয়া, অর্ঘদীপ পানিগ্রাহী, কাব্যিকা দাশগুপ্ত, বন্ধু সুন্দর পাল, রূপায়ন মন্ডল, সোহিনী সামন্ত, অনিন্দিতা চৌধুরী, তোহাদ্দেশ সেখ, রবীন বসু



■ কবিতা (কবিতার ল‍্যাব) : অনুরূপা পালচৌধুরী
                    
■  এক গুচ্ছ কবিতা : পাবলো শাহি



■ ছড়া নাটিকা : সতীশ বিশ্বাস

■ ছড়াক্কা : তোহাদ্দেশ সেখ, শিল্পী গঙ্গোপাধ্যায়

■ লিমেরিক : মানবেন্দ্র ব‍্যানার্জী

◆ পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক গদ‍্য : রাহুল গাঙ্গুলী

◆ প্রবন্ধ : পবিত্র চক্রবর্তী, ডঃ মীনা মুখোপাধ্যায়

◆ আত্মজীবনীমূলক গদ‍্য (ধারাবাহিক) :
                                           প্রভাত চৌধুরী

◆ মুক্ত গদ‍্য : মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী, জয়দীপ রায়, জয়িতা ভট্টাচার্য, মানসী মন্ডল, পদ্মাবতী রায় চৌধুরী

◆ অনুগল্প : চারু, সিলভিয়া ঘোষ, তনিমা হাজরা, শিল্পী সিংহ, বনবীথি পাত্র

◆ ছোট গল্প : রাজর্ষি বর্ধন, মানসী গাঙ্গুলী, কাব্যিকা দাশগুপ্ত,  বৈশাখী চ্যাটার্জী, ফিরোজ আখতার

◆ বড়ো গল্প : পায়েল খাঁড়া

◆ উপকথা : মধুশ্রী ভট্টাচার্য্য

◆ উপন্যাস (ধারাবাহিক) :
                  দেবশ্রী চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় রায়


ধন‍্যবাদান্তে
সম্পাদক,
‘এখন তরঙ্গ’



●●●●

সম্পাদকীয়





মনোরম আবহাওয়া দেখে কবর থেকে উঠে এসেছিল যে মামদো ভুত, ভেবেছিলাম সে ফিরে যাবে আবার কবরে, দিগন্ত থেকে উড়ে আসবে জালছেঁড়া প্রজাপতির দল। মণিন্দ্র গুপ্তে’র ভবিষ্যতবাণী’কে সত্যি করেও, অকালবৈশাখীতে ভিজে যাবে গনগনির মাঠ।

না, হয়নি, হয়নি কোনটাই। মামদো ভুতেরা আজ’ও আমাদের চারদিকে ঘুরঘুরে পোকার মতো ঘোরে। আমাদের অস্তিত্বের সবটুকু ঝাঁকিয়ে দিয়ে কেউ বলে ওঠে, ‘তুমিও তো আদতে পুংলিঙ্গই’.......অতঃপর, এক জমাট অন্ধকার….চোখের সামনে……..লজ্জায়, ঘৃণায়, ভয়ে…...চোখ বুজে আসে…..আমারও যে একটা ‘আসিফা’ আছে…….

তবু বাঁচতে হয়, তবু হাসতে হয়, খেতে হয়, শুতে হয় এবং সেক্স……..ভুলে যাই সবকিছুই বা ভুলে যেতে হয় বলে…….ঠিক এরকম সময়েই কেউ প্রেমের গান বন্ধ রেখে হাতে তুলে নেয় কাস্তে, কেউবা পূর্ণিমার চাঁদের মুখে লজ্জা ছুড়ে দিয়ে বলে ওঠে, তুমি কিন্তু মোটেই সুন্দর নও, তুমি তো আদতে ঝলসানো রুটি, আবার কেউবা মুক্তি খোঁজে আলোয় আলোয়, ঘাসে ঘাসে…….ঠিক তেমনই এক অন্ধকারে আমাকে আলো দেখিয়েছিল, আমার চোখে চোখ রেখেছিল, আমাকে দু’দন্ড শান্তি দিয়েছিল ‘নাটোরের বনলতা সেন’।

হয়তো ভাবছেন, এটা কী হলো? দারুচিনি দ্বীপের খোঁজ আমি পেলাম কীভাবে? কীভাবেই বা পেলাম, বনলতা সেনের চোখে চোখ রাখার অধিকার?

স্বীকার করছি, পাইনি। ওটা ডাঁহা ঝুট…..সব ঝুট হ‍্যায়….সব ঝুট হ‍্যায়….তফাৎ যাও….এই সূত্র ধরেই নিশ্চিত ভাবে পেয়ে গেলাম বনলতা সেনের ঠিকানা। শুধু আমি নয়, আপনিও পেতে পারেন তাঁর ঠিকানা, চোখে চোখ রাখার অধিকার, শুধু জানতে হবে, বনলতা সেন আদতে কে? এবং কী?

বনলতা সেনকে নিয়ে লেখা অনেক হয়েছে, হবে আর’ও। হোক, ক্ষতি নেই। তাঁদের সব ধারণাকে অস্বীকার না করেও নাস‍্যাৎ করে বলছি, আমি যা বলব, সেটাই সঠিক।

একটা মানুষ এবং পুরুষ, দেখতে ভালো নয়। অথচ, মারাত্মক রোমান্টিক। সে কবিতা লেখে, সে গান শোনে, সে নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দেখে স্রোত ভাঙার নিশিডাক, সে প্রকৃতির চোখে চোখ রেখে অনায়াসে পড়ে নিতে পারে সবটুকু ভ্রুকুঞ্চন। অথচ, কী আশ্চর্য, কোনও নারীর চোখে চোখ রাখার সাহসটুকু নেই, কলেজে পড়াতে গিয়েও কলেজ ঢোকে পিছনের দরজা দিয়ে, মুখ নিচু করে। লাজুক কি? না, লাজুক নয়। মুখের সামনে আয়না ভেসে ওঠে…...যদি কেউ তার অসুন্দর চেহারা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি কারো মুখ বেঁকে যায় ঘৃণায়? তাহলে? এবং তাহলে? এই উপেক্ষা, এই ঘৃণাকে সে বয়ে বেড়াবে কীভাবে? তাইতো সে ‘মশারি’ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় মৌসুমী সমুদ্রের দিকে প্রতি রাতে, প্রতি রাতে সে ‘ঘাস’ খেতে যায় জ‍্যোৎস্না মেখে মহীনের ঘোড়া হয়ে। সে জানে, তার জন্য অপেক্ষা করে নেই কেউ, এমনকি তাঁর স্ত্রী’ও। সে জানে, এর থেকে মুক্তি নেই এই জীবনে, সে জানে স্ত্রী নয়, শিশু নয়, মাথার ভেতর ঘুরঘুরে পোকার মতো কেউ ঘোরে বা জলের মতো, তাইতো সে চিত হয়ে শুয়ে থাকে টেবিলের উপর।

আদতে এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতর, তাকে এড়ানোর উপায় তার জানা ছিলনা, প্রয়োজন’ও তো ছিল না। অন্তত, কেউ তো তার সাথে কথা বলে, কেউতো হাত রাখে হাতে, কেউ তো সাগ্রহে জিগ্যেস করে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

‘বনলতা সেন’ আদতে আর কিছুই নয়, বোধ। কবির অন্তরের সেই কবিটি, যার খোঁজ পেলে, যার মুখোমুখি বসলে ফুরিয়ে যায় জীবনের সব লেনদেন, সব চাওয়া-পাওয়া, সবটুকু অভাব-অভিমান-অভিযোগ…...অতঃপর এক নিশ্চিত সমর্পণ। আপনি অনায়াসে একে মনের মানুষ বলতেই পারেন বা সেই যে ব্রহ্মজ্ঞান।

একটু কঠিন হয়ে গেল ব‍্যাপারটা? আসুন একটু সহজ করেই আলোচনা করা যাক। আমরা আমাদের আলোচনাকে এই মুহূর্তে কবি ও কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি, তাহলে আরও সহজ হবে বুঝতে।

আমি যখন লেখালেখির জগতে এলাম, এই মে-জুন মাসে, তখন তিনজনের কবিতা আমি খুব পড়তাম (এখনও পড়ি).......মহাদেবাশা, ফারজানা মণি এবং ঐন্দ্রিলা মোহিন্তা। কিছুদিন পরেই এর সাথে আর একটি নাম যোগ হল, মনোজ দে। এদের লেখা পড়ে চমকে যেতাম এবং শিখতাম (এখনও)। তা, হয়েছে কী….কয়েক মাস আগে, মহাদেবাশা হঠাৎ লেখা প্রায় ছেড়ে দিল। একদিন ফোন করলাম ওকে, জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ লেখা ছেড়ে দিলে কেন? ও বলল, ‘দাদা, লিখে কী হবে? আমি তো কবিতায় আছি। এই যে আমার সামনে যা কিছু হচ্ছে, এই যে হর্নের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো, এর মধ্যেও আমি কবিতা খুঁজে পাই, ফালতু লিখে কী হবে?’

চমকে গেলাম, তবে ভাবলাম, ধূর, ফালতু কথা। বিরক্তিকর হর্নের আওয়াজেও কি কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? হয়তো কোনও অভিমান, হয়তো কোনও হতাশা থেকে সাময়িক বিরতি। এরকম ফেজ্ অনেকের জীবনেই আসে। ঠিক ফিরে আসবে একদিন, ওকে শুধু বলেছিলাম, ফিরে এসো। না, ফিরে সে এখনও আসেনি, তবে ঐন্দ্রিলার জন্য কাল জানতে পারলাম, সে কবিতায় আছে। কবিতা লেখেও, তবে বিশেষ কারণে। পত্রিকায় ছাপার জন্য নয়।

মহাদেবাশার ব‍্যাপারটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, খুঁজতে লাগলাম আবার নতুন উদ‍্যোমে, কবিতা আদতে ঠিক কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়?

ঠিক এরকমই সময়ে হাতে এলো, অমিতাভ প্রহরাজদার একটা লেখা, যেখানে তিনি কবিতার জিনটাকে স্পষ্ট করে ধরেছেন। তিনি সূত্র দিয়েছেন, কীভাবে একটা লেখা পড়ে বুঝে নেওয়া যায়, এটা গদ‍্য না কবিতা বা একই লেখার মধ্যে কোন কোন অংশ কবিতা আর কোন কোন অংশ গদ‍্য। সম্পাদনার ক্ষেত্রে এই সূত্রটা আমার খুব উপকার করেছে এবং অবশ্যই ব‍্যক্তিগত ভাবে লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রেও। সূত্রটা হলো, কোনও লেখা পড়ে তোমার মনে কী হ‍্যাঁ বা না আসছে? তর্ক করতে ইচ্ছে করছে? নিশ্চিত সমর্পনের বিপরীতে হাজির হচ্ছে সত্য বা মিথ্যার দ্বন্দ্ব? তাহলে, নিশ্চিত সেটা কবিতা নয়, গদ‍্য। কারণ, কবিতা আদতে হ‍্যাঁ বা না, সত‍্য বা মিথ্যার মধ‍্যবর্তী এমন এক অঞ্চল যেখানে শুধু নিশ্চিত সমর্পণ থাকে। আঙুল তোলা যায় না, শুধু চোখে চোখ রাখা যায় বা হাতে হাত।

অনেকে বলেন বা মনে করেন, কবিতার শুধু দুটো দিক থাকে, ভালো লাগা বা খারাপ লাগা। আমি কিন্তু মোটেই এটা মনে করিনা, আমি মনে করি, কবিতার শুধু একটিই দিক থাকে, এবং সেটা শুধুই ভালোলাগা, নিশ্চিত সমর্পণ। (প্রভাত চৌধুরীও এটা বলেন। পরবর্তী অংশে, আমি প্রভাত চৌধুরীকে ‘ভুল’ প্রমাণ করব, প্রভাত চৌধুরী’ই অস্ত্রে।)

আবার গুলিয়ে গেল ব‍্যাপারটা? ভাবছেন, এতো যে কবিতা লেখা হচ্ছে, সবই কি ভালো লাগে নাকি?
না, একদম না, ভালো লাগে না, কারণ সেগুলো কবিতাই নয়। আরে মশাই, কবিতা যে লেখাই যায় না, কবিতা যে আদতে একটা বোধ, একটা উপলব্ধি, একটা অনুভব। তাকে পুরোপুরি ধরা যায় না, লেখা তো যায়ই না, একটা আলো-আঁধারি খেলা। আলো, যখন জ্ঞান এসে হাজির হয়, যখন বাস্তবের চাওয়া পাওয়াগুলো সুরুৎ করে ঢুকে পড়ে আমাদের মাথার ভিতর। অন্ধকার, যখন জ্ঞানের বাইরে দাঁড়িয়ে, চাওয়া পাওয়াহীন মৌনতা, যখন কোনও প্রশ্ন নেই, কোনও উত্তর নেই, যখন একান্তে আপন কথা আপন জনারে। জ্ঞানের অহং-আলো ফুরিয়ে যখন সন্ধ্যা আসে, যখন অহং ভেদ করে, জ্ঞান ত‍্যাগ করে, ‘জানা’ ত‍্যাগ করে ‘চেনা’ এসে সামনে দাঁড়ায় তখনই তো ‘আমি’ প্রস্তুত হয় ‘আমি’র মুখোমুখি হওয়ার। এই অন্ধকার জ্ঞানহীনতার নয়, জ্ঞানের অহং ত‍্যাগ করে প্রশ্নহীন ও দ্বীধাহীন আত্মসমর্পণের।

(জানা ও চেনার মধ্যে পার্থক্যটা ঠিক কতটা, একটা ঘটনার উল্লেখ করলে বুঝতে পারবেন।
কিছুদিন আগে একটা বিষয়ে আলোচনা করতে করতে প্রভাতজ‍্যেঠু হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের একটা বিশেষ দিক নিয়ে লিখতে বললেন আমাকে।
আমি বললাম, জ‍্যেঠু আমি পারব না।
উনি বললেন, কেন?
উত্তর দিলাম, আমি তো রবীন্দ্রনাথকে চিনিই না। জানি হয়তো, কিন্তু চিনি না।
তখন উনি বললেন, অহ্, তাহলে তুমি পারবে না।

জানা ও চেনার পার্থক্য ঠিক এতটাই। মধ‍্যবর্তী অঞ্চলে দু-চারটে আলোবর্ষ অনায়াসে নাক ডাকিয়ে ভাতঘুম দিতে পারে।)

একটু স্পষ্ট করেই বলা যাক ব‍্যাপারটা, কয়েক মাস আগে আই-সোসাইটি নিয়ে একটা গদ‍্যে আমি লিখেছিলাম, কবিতা আদতে তিনটি,
প্রথম কবিতা : যা আমাদের চিন্তনে সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয় কবিতা : প্রথম কবিতার লিখিত রূপ।
তৃতীয় কবিতা : দ্বিতীয় কবিতা পড়ে পাঠকের মধ্যে যে অভিঘাত বা পাঠকের মধ্যে সৃষ্ট যে কবিতা।

অদ্ভুত সুন্দর ঘটনা হলো, এই তিনটি কবিতা মোটেই এক নয়, বা এক হতেও পারে না। গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার মতো ক্রমাগত পাল্টে ফেলে তার রূপ। তাইতো সে এতো সুন্দর। (এই ধারণার জন‍্য আমি অনিন্দ্যদার (রায়) কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী।)

প্রথম কবিতা বা আদতে যেটি সৎ কবিতা, তা প্রশ্নহীন। এটা সৃষ্টি হয় আমাদের মধ্যে প্রতি মুহুর্তেই, শুধু কবি বা সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে নয়, সমস্ত মানুষের মধ্যেই। কিন্তু সবাই ধরতে পারে না বা বুঝতে পারে না কারণ রিসিভারটা যে তাদের কাছে নেই, রিসিভারটা জন্মদত্ত। একমাত্র সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যেই থাকে এই রিসিভার, সে অনুভব করতে পারে ভিতরের সৃষ্টিশীলতার জন্মটাকে, তারপর সে সেটাকে ধরার চেষ্টা করে তার সৃজনশীল কাজের মধ্যে দিয়ে। কবির ক্ষেত্রে কবিতায়। প্রশ্নটা কিন্তু অনুভবের নয়, প্রশ্নটা যাপনের। আরও ভালো করে বললে, ভিতরের সৃষ্টিশীল ‘আমি’র সাথে একাত্ম হওয়ার। এখানেই একটা শব্দ এসে উপস্থিত হয়, সাধনা। একটা দীর্ঘপথ, যার শেষে কবি মুখোমুখি হয় অন্তরের কবিটির, আমি মুখোমুখি হয় অন্তরের ‘আমি’র, জীবনানন্দ মুখোমুখি বসবার অবকাশ পায় নাটোরের বনলতা সেনের। অর্থাৎ, স্পষ্ট ভাবেই বলছি, বনলতা সেন জীবনানন্দের প্রেমিকা নয়, বাস্তব অস্তিত্ব থাকতে পারে বা নাই থাকতে পারে, তাতে কিছু এসে যায় না, বাস্তবজীবনে প্রেমহীন, নারীহীন, সাংসারিক অশান্তি, চরমতম আত্মবিশ্বাসহীন অবস্থা থেকে মুক্তি খুঁজে পান যখন মুখোমুখি হন তাঁর ভেতরের কবিটির সাথে, সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন সে কীভাবে অনবরত ঘুরে ঘুরে কথা বলে তার সাথে, কীভাবে ভিড়ের মাঝেও সে একান্তে পেতে চায় কবিকে, কীভাবে তার মুখোমুখি বসলে জৈবিক চাহিদাগুলো জাস্ট ভ‍্যানিস হয়ে যায়, একটা অদ্ভুত সুন্দর শান্তি হেঁটে যায় অস্তিত্বের সবটুকু পথ ধরে। (যারা, লেখালেখি করেন তারা জানেন, কীভাবে আমরা হঠাৎ হঠাৎ অন‍্যমনস্ক হয়ে যাই, কোথায় যেন হারিয়ে যাই আমরা, কেউ যেন কানে কানে বলে যায় কিছু লাইন, কেউ যেন কথা বলে আমাদের সাথে। হয়তো খেতে বসে খেতে ভুলে যাই বা প্রেমিকার ঠোঁটে রাখতে ঠোঁট হঠাৎ। এরজন্য কম গঞ্জনা শুনতে হয় না আমাদের, বৌ বলে, একটু সংসারী হও, শালী বলে মৌন জামাই, আর বন্ধুরা বলে…..থাক, ওটা এখানে না বলাই ভালো)। বনলতা সেন আদতে কবির প্রেমিকা। হ‍্যাঁ, ব‍্যক্তি জীবনানন্দের নয়, কবি জীবনানন্দের প্রেমিকা। কবির ভালোবাসা অন্তরের কবির প্রতি। পুরুষ কবি স্বাভাবিক ভাবেই ভিতরের ‘আমি’কে কল্পনা করেছেন নারীরুপে, নাহলে মিলন হবে কেমনে? আর, বনলতা সেন’ অবশ্যই একটি মাত্র কবিতার নাম’ও নয়, আমাদের প্রত‍্যেকের ভিতরে সৃষ্টি হওয়া প্রথম কবিতাকে অনায়াসে ডাকতে পারি, হ‍্যালো মিস্ বনলতা সেন, হাও আর ইউ ডার্লিং? (মিস্, মিসেস নয় কিন্তু। মিসেস হলেই জাগতিক চাওয়া পাওয়ার মোচার ঘন্ট।)

সমস্যা কিন্তু প্রথম কবিতাকে নিয়ে নয়, সমস্যা শুরু হচ্ছে দ্বিতীয় কবিতা থেকেই, কারণ এখান থেকেই শুরু হচ্ছে, কলমের কেরামতি এবং কবিদের কাঁকড়ামি। দ্বিতীয় কবিতার সাথেই জড়িয়ে পড়ছে ‘কবি’ নামক ভয়ঙ্কর সুন্দর জীবটি। যে আঁচড়াতে জানে, খামচাতে জানে, বুকে মেডেল ঝুলিয়ে সেল্ফি তুলতেও জানে এমনকি তার পাঠকের মনে ছিটিয়ে দিতে পারে শান্তিজল।

দ্বিতীয় কবিতায়, কবি প্রথম কবিতাকে কপি করার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে তাঁর ভেতরের কবিতাকে শব্দে বাঁধতে। কিন্তু, পুরোপুরি কখনোই সম্ভব হয় না। এই পুরোটা ধরতে না পাড়ার তাড়নাটাই কবিকে বাধ্য করে বারবার ‘কবিতা’ লিখতে। হেঁটে যেতে সবটুকু কবিতার ভিতর। কয়েকদিন আগে, সুদীপ (ব‍্যানার্জি) আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা আমার লেখা কি হচ্ছে না? কনফিউজড।’ আমার কিছু বলার ছিল না, তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো জ্ঞান’ও আমার নেই, শুধু বললাম, ‘একটা কথা বলতে পারি, নিজের লেখা নিয়ে নিজের মনে প্রশ্ন আসা মানে তুমি সঠিক পথে আছো।’

হ‍্যাঁ, এটাই কোনও কবির (যেকোনও সৃষ্টিশীল মানুষের) চালিকাশক্তি। এটা হতেই পারে পাঁচন বা অঙ্কুশ, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই জানি, এটাই প্রভাত চৌধুরীর ‘আপডেটেড ভাবনা’, যার ফলাফল ‘আপডেটেড কবিতা’।

কিছুদিন আগে একজন বলল, ‘আমি কবিতা পাক্ষিকে কবিতা পাঠাতে চাই’। আমি বললাম, খুব ভালো, পাঠাও। তখন সে বলল, ‘কিন্তু আমার কবিতাগুলো কি আপডেটেড? তুমি একটু চেক করে দাও’। আমি তখন জিগ্যেস করলাম, আপডেটেড কবিতা বলতে তুমি কী বোঝো? সে বলল, ‘ওই যে একটু ইংরেজি শব্দ থাকবে, একটু খটখটে, রসহীন কবিতা’। বুঝলাম, যে ভুলটা আমি করেছিলাম একদিন, সেই ভুলটা রয়ে গেছে এখনও।

পরিস্কারভাবে বলছি, এটা মোটেই আপডেটেড কবিতা নয় বা এটা মোটেই আপডেটেড কবিতার বৈশিষ্ট্য নয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপডেটেড কবিতার কোনও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য হয় না, হয় না বলেই প্রভাত চৌধুরী বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেননি। আপডেটেড কবিতা আদতে একটা জার্নি…...জার্নি টু কবিতা। একটা খোঁজ, খোঁজ আরও নতুন কিছুর। লেখার মধ্যে নতুন নতুন অঞ্চল সৃষ্টি। ধরা যাক, তুমি চাঁদকে নিয়ে কিছু লিখছো, চাঁদকে নিয়ে তো প্রচুর লেখা হয়েছে, তুমি নতুন কী দিতে পারছো? যা আগে কেউ দেয়নি, চাঁদকে নিয়ে এমন কী ভাবতে পারছো? যা আগে কেউ ভাবেনি? একটা উদাহরণ দিলেই ব‍্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, “আকাশে ক্ষমার মতো চাঁদ ওঠে” (কবির নাম মনে নেই)। এটাই আপডেটেড ভাবনা, এটাই আপডেটেড কবিতার প্রতি যাত্রা। প্রতি মুহূর্তে ভাবনাকে আরও বিস্তৃত করা, আরও ছড়িয়ে দাও, আরও বহুমাত্রিক হয়ে ওঠা, নতুনের সন্ধানে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়াই আদতে আপডেটেড থাকা। থেমে থাকা মানে তো পিছিয়ে যাওয়া, তাই, আপডেটেড ভাবনায় থামার কোনও সুযোগ নেই, সুযোগ নেই নিজের লেখার প্রতি প্রশ্নহীন থাকা, এটা একটা নেভার এন্ডিং প্রসেস্। এই প্রসেসের ফলস্বরূপ যে ‘আপডেটেড কবিতা’, তা থেকে যাবে চিরদিনই অধরা, ততদিন পর্যন্ত কোনও লেখা ‘কবিতা’ হয়ে উঠবে না, কবিতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে যাবে মাত্র। এটা অনেকটা একটা একটা করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো। খোসা ছাড়ালে ঝাঁঝ উঠবেই, এই ঝাঁঝটাই বলে দেবে তুমি আপডেটেড আছো কিনা, পেঁয়াজটা হাতে ধরে বসে থাকলে তো আর ঝাঁঝ উঠবে না। প্রভাত চৌধুরী কবিতার মধ‍্যে শুধু দেখে নেন এই ঝাঁঝটা আছে কিনা, কারণ তিনিও জানেন আপডেটেড কবিতা কোনদিনই লেখা সম্ভব নয়। কারণ আজ যা নতুন, কাল তা পুরাতন। চরম এবং পরম বলে কিছু হয়না পৃথিবীতে, সবকিছুই আপেক্ষিক। এই ঝাঁঝালো গন্ধটা আমি অনেকের কবিতা থেকেই পাই, এমনকি তাঁদের থেকেও যাঁরা আপডেটেড কবিতাকে গালি দেন বা মনে করেন না তাঁদের কবিতা আপডেটেড পথে যাত্রা করেছে। আর এই জন্যই আমি প্রভাত চৌধুরীর কথার বিরোধিতা করে বলছি, কবিতা শুধু মাত্র ভালো লাগার জন্ম দিতে পারে, খারাপ লাগা নয়, কারণ কবিতা চিরদিনই অধরা থেকে যাবে, আমরা যা লিখি তা তো কবিতাকে ধরার চেষ্টা মাত্র। এই চেষ্টাটুকু অবশ্যই ভালো লাগতে পারে বা খারাপ।

অতঃপর তৃতীয় কবিতা, এটাই সবচেয়ে বেশি গোলমেলে এবং এটাই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে কবিকে। এই তৃতীয় কবিতার জন‍্যেই কবি অসৎ হতে বাধ‍্য হয়। পাঠকের মন বুঝে লেখে, আই মিন্ কবিতা তৈরি করে। হ‍্যাঁ, কবিতা তৈরি করা যায়। চুরি করে, শব্দ সাজিয়ে এবং তা কবিতা বলে চালানো যায় এবং চলেও যায়। এই তৃতীয় কবিতার বাধ‍্যবাধকতাতেই কবি নিরালা পথ ছেড়ে উঠে আসে খোলা বাজারে। মুখ দেখানোর প্রবণতা আদতে কবিতা বিক্রির বিজ্ঞাপন। (স্বাভাবিক ভাবেই তৃতীয় কবিতা পাঠক ভেদে আলাদা।)

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমিও এর শিকার। এই হট্টগোলের রাজনীতিতে গুলিয়ে গেছে আমার কবিতার সহজ সমীকরণ। সত্যি আমি ক্লান্ত, আমি বিরক্ত। আর ভালো লাগছে না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, আমি সত্যিই পাখি হতে চাই। তাই, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপততত এটাই আমার শেষ সম্পাদনা। আমি এবার নিজের মতো করে লিখতে চাই, সবচেয়ে বেশি করে পড়তে চাই। লেখালেখির মানুষের একটা প্রস্তুতি পর্ব থাকা বাধ্যতামূলক। ফেসবুকে ভর করে আমি সেটা ডিঙিয়েই চলে এসেছি লেখালেখির জগতে। প্রস্তুতিহীনতার অভাবটা টের পাচ্ছি এখন, প্রশ্ন উঠছে নিজের মনেই। তাই, আমি সম্পাদনা ছাড়ছি। সময়টা দিতে চাই পড়াশোনায়। তাছাড়া, আমার সন্তানের শৈশবকে তো অস্বীকার করতে পারিনা, ওটাও যে আমার কবিতা, আমার ‘বনলতা সেন’।

সিদ্ধান্তের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে জানুয়ারি মাস থেকেই। কৈশোরের প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে, লভ্ মি….লভ্ মি নট্ করতে করতে অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছি, আমি সম্পাদনা ছাড়ছি এবং তরঙ্গ’ও।

এই সংখ‍্যার শুরুতেই আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি সম্পাদনা ছাড়ব, তাই লেখার আহ্বানের সুরটাও ছিল একটু অন্য রকম। ঠিক এই কারণেই, ভোটের অজুহাত দিয়ে পত্রিকা প্রকাশের দিনটাকে এগিয়ে নিয়ে আসা, যাতে পরবর্তী সম্পাদক বা সম্পাদক মন্ডলী প্রস্তুতির সময়টুকু পায়। আর এই কারণেই সম্পাদক মন্ডলী ভেঙে দেওয়া, তারজন্য একটু নাটক করার বা শাল‍্যদানীকে দিয়ে নাটক করানোর প্রয়োজন ছিল। (ও বেচারি জানেও না, ওকে দিয়ে আমি এই নাটকটুকু করিয়েছি, ও সেটাই করে যেটা আমি বলে দিই, এমনকি সমস্ত ঘোষণার লেখাটুকুও এডিট করিয়ে নেয়, হ‍্যাঁ এতটাই বিশ্বাস ও নির্ভর করে ও। তাই এই নাটকটা করতে খারাপ লেগেছে আমার, কিন্তু আমি নিরুপায়, সত্যিটা বলে এটা করানো যেত না হয়তো। যাইহোক, তারজন্য দুঃখিত) সম্পাদকীয়তে আমি যা লিখলাম, তা সম্পাদক মন্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করে লেখা ঠিক হবে না মনে করেছি বলেই সম্পাদক মন্ডলী ভেঙে দিয়েছি। যদিও, আমি কোনদিন সম্পাদক মন্ডলী কনসেপ্টে বিশ্বাস রাখিনি। এই ব‍্যাপারে আমি চরমভাবে একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমি সেটাই করেছি, যেটা আমার মনে হয়েছে। সম্পাদক মন্ডলীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে কাজ করে গেছি, তারপরও ওরা কেউ সামান্যতম অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করেনি, তারজন্য আমি ওদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ এই জন‍্যেও যে, যখনই যায় কাছে কোনও সাহায্য চেয়েছি, তারা নির্দ্বিধায় করেছে।

যাইহোক, যাবার আগে কিছু কথা বলা যাওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে, যাতে পরবর্তী সম্পাদক মন্ডলী একটা স্পষ্ট রোডম্যাপ থাকে।

১। ‘এখন তরঙ্গ’কে বাংলা সাহিত্যের Open platform করতে চেয়েছিলাম এবং করেছি। চেয়েছিলাম সাহিত্যের প্রতিটি ধারা একই পত্রিকার মধ্যে ধরতে, এবং সেটা সফলতার সাথেই করেছি। অনুপম মুখোপাধ্যায়, ব‍্যঙ্গ করে বলেছিল, ‘তুমি কি বাংলা সাহিত্যের জুকারবার্গ হতে চাও নাকি? সব ধারাকে একসাথে ধরা?! পত্রিকা না লঙ্গরখানা? প্রতিটি পত্রিকার একটা নির্দিষ্ট চরিত্র থাকে, কিন্তু তোমার পত্রিকার কোনও চরিত্রই নেই, বেশ‍্যাদের মতো, প্রতি রাতে খদ্দের পালটায়’। ঠিক, একদম ঠিক, এটাই বলেছিলাম ওনাকে, আরও বলেছিলাম, ‘চরিত্রহীনতা’ই হবে আমার পত্রিকার চরিত্র। দেখা যাক, ‘জুকারবার্গ’ হতে পারি কিনা। হ‍্যাঁ, পেরেছি। কারণ বিশ্বাস ছিল নিজের উপর আর ভরসা ছিল আমার জন্মগত জেদের উপর। পরবর্তী সম্পাদক মন্ডলী এই বিশ্বাস ও জেদটা বজায় রেখ।


২। প্রতি সংখ‍্যায় কমপক্ষে ৫ টি করে জায়গা রাখতাম একদম নতুন কলমের জন্য। এমন কলম, যারা আগে কখনও কোথাও লেখেনি। পত্রিকার ছাপানোর যোগ্য কিনা ভাবিনি, শুধু একটা সুযোগ সামনে রেখেছি তাদের। কারণ, আমি বিশ্বাস করেছি, একটা সুযোগ এনে দিতে পারে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস। আমি ভুল করিনি, তার কারণ তাদের মধ্যে সাতজন এখন নিয়মিত লিখছে বিভিন্ন পত্রিকায়। পরবর্তীর কাছে অনুরোধ, নতুনদের সুযোগ দিও, নিঃস্বার্থভাবে।

৩। স্কুল পড়ুয়াদের লেখা সেভাবে আমি যোগাড় করতে পারিনি, এই ব‍্যাপারে আমি ব‍্যর্থ। পরবর্তীতে তোমারা এটাকে এগিয়ে নিয়ে যেও সফলভাবে।

৪। ‘আঞ্চলিক উপভাষা’ এই ট‍্যাগ লাইনটা এই সংখ‍্যা থেকেই তুলে দিয়েছি। আঞ্চলিক ভাষায় লেখা কবিতা রেখেছি ‘কবিতা’ বিভাগেই। ব‍্যাপারটা মাথায় রেখ।

৫। সূচীপত্রে নামের তালিকায় আমি ‘ছোট’ কবি/লেখক, ‘বড়ো’ কবি/লেখক ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছি। এটা বজায় রাখার অনুরোধ রইল।

৬। সম্পাদক হিসেবে আমি অন্য কোনও পত্রিকার সাথে শত্রুতা বা অসহযোগিতায় বিশ্বাস রাখিনি। তাই, নির্দ্বিধায় অন্য পত্রিকার লিঙ্ক, লেখা আহ্বান শেয়ার করেছি। ভিতর থেকেও সাহায্য করি এবং করেছি অনেক পত্রিকাকেই। এই স্পিরিট’টা বজায় রেখ।

৭। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমি অন্য কোনও সমীকরণ মাথায় রাখিনি। এমনকি আমার ব‍্যক্তিগত বিরুদ্ধাচারণ করা কলমের’ও লেখা ছেপেছি। কারণ আমি প্রত‍্যেককে কলম হিসাবেই দেখেছি, ব‍্যক্তি হিসাবে নয়। মনে রেখ, কলমের সাথে শত্রুতা করা যায় না।



অতঃপর, কিছু কথা স্পষ্ট করে বলে নেওয়াই ভালো, নাহলে, অনেকে যে ভেবে বসে আছেন, আমি আদতে একটি গভর্মেন্ট রেজিস্টার্ড ব‍্যক্তিগত সম্পত্তির বিনা পয়সার পোষা ভৃত্য, তরঙ্গ ছাড়া আমার গতি নেই, তরঙ্গ ছাড়া আমি চলতেই পারব না, তাদের ভুলটা থেকেই যাবে। যাবার আগে, ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে যাওয়াই ভালো লক্ষণ।

তরঙ্গ মোটেই গভর্মেন্ট রেজিস্টার্ড নয়, নয় কোনও হাউস। (থাকলে আমি অন্তত জানতে পারতাম, বা তরঙ্গের ব্লগে রেজিস্টার নাম্বারের উল্লেখ থাকতো।)
১০ই নভেম্বর ২০১৬ সালে কয়েকজন কয়েকজন বন্ধুর Whatsapp group আড্ডার মাঝে হঠাৎ সৃষ্ট, সৃজনশীল কাজের একটা প্লার্টফর্ম খোঁজার শুরু। (তরঙ্গের ব্লগে About তরঙ্গে ইতিহাসটা কিছুটা পাবেন)। যাইহোক, লীনাদির পরমর্শে এবং সক্রিয় সহযোগিতায় সাহিত্য পত্রিকা ‘এখন তরঙ্গ’ শুরু। Pdf আকারে। নীরবতা, বিজন পন্ডিত, ব্রতশুদ্ধ, ফারজানা মণি, রাহুল গাঙ্গুলীর হাত ধরে তরঙ্গ এগিয়ে চলে। ওদের পরিশ্রমে বেশ কিছু ভালো মানের পত্রিকা সৃষ্টি হয়। (ব্লগে পুরনো পত্রিকার লিঙ্ক পাবেন) যদিও মাঝে মধ্যে অনিয়মিত হয়ে পড়ে তবু পত্রিকা বেঁচে ছিল। রাহুলদা তখন প্রধান সম্পাদক, পত্রিকা ফিরে আসে আবার। সেইসময়, শাল‍্যদানীকে পরামর্শ দিই pdf নয়, ব্লগে আসতে। যেচে উপকারের ফর্মুলা মেনে বাঁশটি এসে ঢোকে……...যাইহোক, তরঙ্গে আমার অন্তর্ভুক্তি প্রথমে ব্লগের কাজ করার জন্য, শর্ত রেখেছিলাম একটাই, কোথাও আমার নাম থাকবে না। সপ্তম সংখ্যা সেইভাবেই চলেছিল। কিন্তু, বিধি বাম হলে যা হয় আর কী, অষ্টম সংখ‍্যা প্রকাশের ঠিক আগে রাহুলদা সরে যাওয়াতে শাল‍্যদানীর অনুরোধে আসতেই হলো সামনে। হ‍্যাঁ, অনুরোধে, কারণ আমাকে নিয়োগ করা যায় না, তাই আমাকে সরিয়েও দেওয়া যায় না, যেমন যায় না, আমাকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া বা আদেশ করা, শুধু যেটা যায় সেটা হলো অনুরোধ, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অনুরোধ।
সম্পাদনার অনুরোধ করাতে, শাল‍্যদানীর কাছে শর্ত রেখেছিলাম একটাই, আমি পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস রাখি, কোনওদিন আমার কাজে কোনও হস্তক্ষেপ করা যাবে না, যেদিন হস্তক্ষেপ করা হবে, সেটাই হবে তরঙ্গে আমার শেষ দিন। আমি স্বীকার করছি, শাল‍্যদানী শর্তটা এই মুহুর্ত পর্যন্ত লঙ্ঘন করেনি, আমি তার জন্য ওর কাছে কৃতজ্ঞ। ও কথা রেখেছে, কিন্তু আমি রাখতে পারলাম না, ওর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমি নিরুপায়, প্রয়োজনটা যে সম্পূর্ণ আমার ব‍্যক্তিগত এবং পারিবারিক।

অতঃপর, নভেম্বর থেকে (অষ্টম সংখ্যা) থেকে শুরু হলো সম্পাদক হিসেবে আমার পথ চলা, লক্ষ্য স্থির করে নিয়েছিলাম আমি প্রথমেই, এমন একটা পত্রিকা, যেখানে বাংলা সাহিত্যের সব ধারা থাকবে। কারণ তখনও পর্যন্ত দেখিনি এমন কোনও পত্রিকার অস্তিত্ব। ছড়া-ছড়াক্কার পাশে কবিতার ল‍্যাব ! এ তো ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। আর, ভিতরে ভিতরে ঠিক করেছিলাম, অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বাকের দম্ভ আমি ভাঙবোই এবং আফজল আলির জিবাকের। ব‍্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন আমাকে এরকম লক্ষ্য স্থির করতে বাধ‍্য করেছিল, যদিও ব‍্যক্তিগত ভাবে ওনাদের দুজনকেই আমি শ্রদ্ধা করি, বিশেষ করে ওনাদের লেখার ভক্ত আমি। তাছাড়া, আমি এটা মনে করি, যে ‘শত্রু’র প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, তার শত্রুতার অধিকারই নেই।

অনলাইন ম‍্যাগাজিন হিসাবে আমি তরঙ্গকে ঠিক কোন জায়গায় নিয়ে এসেছি তার মূল‍্যায়ণ হোক আপনাদের কাছে, তবে এইটুকু নিশ্চিত জানি, তরঙ্গকে সেই জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছি, যেখান থেকে খুলে যায় একটা বিরাট সম্ভাবনা। ঠিকঠাক পরিচর্যা করলে তরঙ্গ অনেক দূর যাবে। আর, পত্রিকার/লেখালেখির মূল লক্ষ্যই হওয়া উচিত লং টার্ম জার্নি। সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কষে শর্টকাট প্রসেসে আস্থা রাখলে পতন অনিবার্য।

সবশেষে বলব, তরঙ্গের প্রত‍্যেকের কাছে, পত্রিকার কবি/লেখকদের কাছে এবং সাহিত্য জগতের অনেকের কাছেই আমি যে সাহায্য, সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। প্রত‍্যেককে আমার ধন‍্যবাদ জানিয়ে…….বিদায়…..


জ‍্যোতির্ময় মুখার্জি
সম্পাদক : 'এখন তরঙ্গ'

মৌসুমী ভৌমিক




কবিতা




ক্ষত

নিহত গোলাপও জানে ব্যথাটা ব্যক্তিগত
তবু ফোটে ফুল
         সুন্দর সু-বাসে
বহন করে যায় নীরবে
                যত হয় ক্ষত।



স্ফুলিঙ্গ

স্রোতস্বিনী খেয়ালী বন্যায়
          যে জোয়ার আসে
তার তরঙ্গে লুকিয়ে থাকে
     এক স্ফুলিঙ্গ।



কান্না

চোখে যে সমুদ্র আছে
      তার বালিয়াড়ি ধরে প্রতিমুহূর্তে
                 হেঁটে যাই।
অসতর্ক মুহূর্তে লিখে রাখি
        কান্না'র গান।



জীবন

মুখোশ দেখলুম, মানুষ দেখলুম
           ছায়া দেখলুম।
হিংসা, ঘৃণা, অবজ্ঞা দেখলুম।
সময়ের স্রোতে সবকিছু হারিয়ে যাওয়া দেখলুম।
অবশেষে জীবন'কেই ভালবাসলুম।




****

রবীন বসু




কবিতা



ক্ষুধার্তের ভাত

হাওয়ার মশারি থেকে যে ঘুম উড়ে গেল
স্লিপিং পিল তার ঠিকানা জানে?
জানে কি স্পিডপোস্টে আসা উপহার
আমাদের আগ্রহের কতটা কাছে?
যে অসভ্য লোকটা মেয়েদের উত্যক্ত করতে
করতে বাসে যাচ্ছিল, তার হাতের লাম্পট্য
শহর কলকাতা থেকে বাঁক নিয়ে শহরতলি হয়ে
মফসসলকে ছুঁয়ে দিতেই
তিন দফার পঞ্চায়েত ইলেকশন এসে গেল l
কবিরা এখন গ্রামমুখী
লিটারারি মিটে ব্যস্ত—
নুন খেয়েছেন, গুণ তো গাইতেই হবে l

কিন্তু নির্গুণ ওই হা-ভাত মানুষগুলোর
জঠরের জ্বালা রৌদ্রদগ্ধ দিনের মতই প্রখর l
প্রকট হল ভারতের অর্থনীতি l
কোন দিকে সে যে যাবে তা বোধহয়
অমর্ত্য সেনও জানেন না l যেমন জানি না আমরা
এত প্রতিশ্রুতি, এত ইলেকশনের পরও
মানুষ কেন পেটপুরে খেতে পায় না?
গ্রাম মহল্লা সর্বত্র কেন এত ভয়?
বিদ্বেষ-বিষ কারা ঢেলে দিচ্ছে মানুষের মনে?

হাতে হাত ধর বাংলা কবিতা
শহর গ্রাম পেরিয়ে সব পুরনো শিকড় ছুঁয়ে
নতুন নির্মাণের জলে ক্ষুধার্তের ভাত সিদ্ধ হোক !




শুকনো ডাঙা

জন্মঘোর কেটে গেলে গ্রীষ্মের চড়ুই পাখি
প্রচণ্ড দাবদাহ চিনে নেয় l
জ্বলন কী প্রচণ্ড ক্ষয় তা জেনে গেল
হরিদাস ছুতোরোর মেয়ে l
তুরপুনে ফুটো হয় আমাদের নিপাট সম্পর্ক
জলাভূমির শামুক জলহীনতায় শুকোয়,
মরবার আগে নিজস্ব লালা আর একবার
চেটে নেয় জীবনের রস l

সমস্ত আশ্লেয শুষে অনির্দেশ যাত্রায়
কোন খামতি নেই, তবুও কোথাও যেন
নিঃশব্দে চুপি চুপি মানুষ বড় একা হচ্ছে
জলহীন রসহীন শুকনো ডাঙা আমাদের ভবিতব্য হবে?


রবীন বসু

প্রভাত চৌধুরী




সুন্দরের দিকে





৫৯ (দ্বিতীয় পর্ব )

পোল্ট্রি মালিকদের প্রেসমিট অন্য আর পাঁচটা  প্রেসমিটের মতোই । একেবারেই ভিন্ন কিছু নয়। তবু মুরগি এবং ডিম কেন্দ্রিক প্রস্তাবনা হল, সম্ভবনার দিকটি দ্যাখানো হল। আমি মজা করে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন আমাদের দেশি মুরগির প্রতি আকর্ষণ জারি থাকবে । শ্যামলদা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ছিলেন, সেটাও মনে আছে। শ্যামলদার কাছে গিয়ে জেনেছিলাম কোনো প্রেসমিটে বেশি কথা বলতে নেই । কথা বললে জলযাত্রার সময় কমে যাবে । তবে এই ধরণের প্রেসমিট সম্পর্কেই এই মন্তব্য ছিল শ্যামলদার ।
এরপর শুরু হয়েছিল ককটেল নামের সেই পর্বের ।এখানে শিখেছিলাম দুহাতে দুটি গ্লাস নিতে হবে, নিয়ে এক কোণে সরে যেতে হবে। দুটো গ্লাস খালি হলে আবার দুটি গ্লাস । ততক্ষণে স্টক কমতে শুরু করেছে । আমাদের কোটা ছিল চার । অতএব  আমরা পদ্ধতিতে কোটা পূরণ করতে সক্ষম হতাম ।
শ্যামলদা একদিন বললেন, তোর সিনেমা দেখতে ভালো লাগে ?  আমি বললাম, কেন ভালো লাগবে না । বেশ ভালো লাগে।
শ্যামলদা কমল চৌধুরীকে ডেকে বলে দিলেন আমাকে প্রেস শো-র কার্ডগুলো দেবার জন্য ।
এভাবেই যাত্রা -র পাশাপাশি সিনেমার সঙ্গেও জুড়ে  গেলাম আমি ।
প্রেস শো গুলো তখন দুপুরের দিকে হত। আবার কোনো কোনোটা সন্ধের সময় ।সন্ধেতে হলে ধরে নিতাম শো-র পরে খানাপিনার ব্যবস্থা থাকবে ।
দুপুরের দিকের শো-গুলিতে আমি বসতাম এক শিখ ভদ্রলোকের পাশে।তাঁর কাছে জেনে নিতাম অভিনেতা -অভিনেত্রী দের নাম।কারণ এখনকার মতো তখনো সব নাম পরিচিত ছিল না । ওই শিখ ভদ্রলোক ছিলেন দৈনিক বিশ্বামিত্র -র ফিল্ম ক্রিটিক।
নাম মনে নেই, তবু এতদিন পর সুযোগ পেলাম ঋণ স্বীকারের।
কেবলমাত্র  একটা প্রেসে  শো র কিছুটা লিখছি ।
রাজ কাপুরের সিনেমা ।সম্ভবত সঙ্গম, দেখার পর গ্রান্ডে খানাপিনার  আয়োজন। Statesman -এর মৃগাঙ্ক দা ছিলেন । আর R K Studio -এর প্রতিনিধি  ছিলেন বিনয়দা।বাকিদের নামটাম মনে নেই । তখন শেষপর্ব।মৃগাঙ্ক দা বললেন বাড়ি ফেরার কথাটা ভুলে যেও না ।
আমি বলেছিলাম, গ্রান্ডে র সামনে রাস্তা থেকে কুঁদঘাটের কন্ডাক্টর ঠিক তুলে নেবে রাস্তা থেকে ।আপনি  অহেতুক চিন্তা করবেন না ।
সেদিন বিনয়দার গাড়িতে ফিরেছিলাম ।সম্ভবত মৃগাঙ্ক দা বলে দিয়েছিলেন বিনয়দাকে।
পরদিন বড়ো করে একটা সমালোচনা লিখেছিলাম । আক্রমণ করে। যোগ করেছিলাম অফ সিনগুলি।
দু এক সপ্তাহ পরে বিনয়দা জানিয়ে ছিলেন রাজ কাপুরের নাকি আমার লেখাটা খুব ভালো লেগেছে ।কারণ এত খোলাখুলি ভাবে অন্য কোনো পত্রিকাতে ছাপা হয়নি।
আমার ভালো শিক্ষা হয়েছিল । এরপর আর এই ভুল আর করিনি। আমি ঠেকে শিখেছিলাম নিন্দা করার কৌশল।
এখনো ভুলে যাইনি, প্রয়োজনে প্রয়োগ করি কিনা আজকের পাঠক তা বলতে সক্ষম হবে। আমি ঠিক  বুঝি না ।




৬০ •দ্বিতীয় পর্ব

শ্যামলদার সৌজন্যে যাত্রা, শ্যামলদার তৎপরতায় সিনেমা, শ্যামলদার আগ্রহের কারণে শিল্প -সাহিত্যের বাদবাকি সবকটি ডানাকে অবলম্বন করে আমাকে  উড়তে হয়েছে । তার বিবরণ নিয়ে সাত কাহন করতে চাইছি না । তবে ডানাগুলির নামকরণ করে রাখতে চাইছি।
এই কর্মসূচিতে যেমন নাটক দ্যাখা চিত্র প্রদর্শনী দেখতে যাওয়া, গানের আসরে ঢুঁ-মারা ছাড়াও ছিল স্পেশ্যাল কিছু লেখা । এভাবেই চলে যাচ্ছিল দিনগুলি এবং সন্ধেগুলি। রাতগুলি তে ছিল দ্যাখা গুলিতে লেখাতে অনুবাদ করা।
এই সুখের দিনগুলি খুব বেশি দিন স্থায়ী হল না । একদিন শ্যামলদা জানতে চাইলেন আমি প্রেম করেছি কিনা।
আমি  অনৃত বচনে অভ্যস্ত নই । বললাম, তা কয়েকটা করেছি।
আদেশ হল, যা করেছিস, লিখে নিয়ে আয়।
এবার সরাসরি প্রশ্ন, কবে দিবি?
দু দিন পর। আমিও কম যাই না।
আমার সাহস এবং স্পর্ধার কোনো সীমা পরিসীমা নেই । বাংলা সাহিত্যের  অন্যতম প্রধান সাহিত্যিকের মুখের ওপর বলে দিলাম, দু দিনে একটা প্রেমের গল্প নামিয়ে দেবো। নামিয়ে দেওয়া টা অশ্লীল শব্দ । কিন্তু একে অন্য কীভাবে লিখবো।
বাড়ি ফিরে লিখতে বসে গেলাম । নিজের প্রেমকাহিনির সঙ্গে জুড়ে দিলাম হীরক -এর প্রেমকথা।
হীরকের একটা অসুখ ছিল, যার নাম --দুঃখবিলাস । দুঃখের বিলাসিতাকে অবলম্বন করে লিখে ফেললাম প্রায় ২০/২২ পৃষ্ঠার গল্প । নাম দিলাম ---অনুপম কাহিনি ।
শ্যামলদার হাতে জমা দেবার সময়ে  আমার একটুও হাত কেঁপে ওঠেনি । আমি এতটাই মুর্খ ছিলাম আমি ।
শ্যামলদা লেখার গোছাটায় আধ মিনিট চোখ বুলিয়ে হাঁক দিলেন ---সুবোধ।
হাজির হলেন শিল্পী সুবোধ দাশগুপ্ত ।
লেখাটা দিয়ে বললেন, প্রভাতের লেখা । ভালো করে ছবি করে দে।
আমি সঞ্জানে এই কর্মকাণ্ড দেখলাম । দু ইঞ্চি -তিন ইঞ্চির কবিতালেখক এতবড়ো একটা গল্প জমা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তা  আর্টিস্টের কাছে চলে গেল। আমি কিন্তু আদৌ অবাক হইনি ।
তার কারণও ছিল । প্রতিটি সপ্তাহে  আমার তখন-চারটি লেখা ছাপা হত অমৃত-যুগান্তর মিলিয়ে । লেখা ছাপা টা আমার  অধিকারের মধ্যে এসে গিয়েছিল ।
পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়েছিল গল্পটি । এই সপ্তাহের  ভালোবাসার গল্প ---ভোলা কঠিন নামে। অনুপম কাহিনি প্রকাশিত হল ভোলা কঠিন নামে।
নামে কীবা এসে যায়। লেখকের নাম তো আর বদলে দেননি শ্যামলদা । সেখানে ৩৬ পয়েন্ট ফ্রন্ট টাইপে ছাপার অক্ষরে প্রভাত চৌধুরীর নাম ।
তখন শ্যামলদার ঘরে প্রতি শনিবার লেখকদের মিটিং হত। উপস্থিত থাকতেন যুগান্তর হাউসের লেখকেরা । অমৃত তে প্রকাশিত সব লেখার আলোচনা হত।সকলকেই মতামত  দিতে হত। সেই মিটিংয়ে থাকতেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কালজয়ী কথাশিল্পীরা ।
আমি পরের শনিবার -এর অপেক্ষা করতে শুরু করলাম।
আপনারা আগামীকালের জন্য ।





৬১. দ্বিতীয় পর্ব

অমৃত-র সাপ্তাহিক মিটিং শুরু হল বিকেলের দিকে ।একে মিটিং বলার কোনো প্রয়োজন নেই, বরং আলোচনা  এবং আড্ডা বলাই ভালো । মিটিং হলে সভাপতি লাগে, প্রধান অতিথি লাগে, বক্তা লাগে। আবার গুটিকয়েক শ্রোতাও লাগে ।
কিন্তু শ্যামলদার এই আড্ডা গুলির অ্যাজেন্ডা একটাই। অমৃত -র সাম্প্রতিক সংখ্যার বিশ্লেষণ ।কোন লেখা কেমন হয়েছে,  তা সম্পর্কে সকলের মতামত ।
একদিকে শ্যামলদা । অন্যদিকে আমরা সবাই । এই  আমরার মধ্যে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় বরেন গঙ্গোপাধ্যায় , সম্ভবত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ও, আরো কয়েকজনের সঙ্গে  আমিও।ভাবা যায় এইসব দিকপাল লেখকের সঙ্গে নিজের নাম টাও যোগ করে নিলাম কী কৌশলে।
অতীনদা ঢুকেই বলে বসলেন, প্রভাত জমিয়ে দিয়েছে। চালিয়ে যাও। অতীনদা কখনোই ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলতে পারেন না।যা বলার সোজাসুজি বলে ফেলেন।ভূমিকা বিহীন বক্তব্য ।
বরেনদা আবার অল্প কথার মানুষ। বললেন, পড়েছি প্রভাতের ভোলা কঠিন, ভালো লেগেছে । এরপর আর কী পাওয়ার থাকতে পারে একজন নবীন গল্পকারের। আরো দু-এক জন প্রশংসা
করলেন। সব নাম, সব মুখ মনে নেই । ভবিষ্যত যে এসব নিয়ে লিখতে হবে তা জানতাম না । জানলে ডাইরিতে নোট রাখতাম।
তার থেকেও বড়ো কথা  অমৃত-যুগান্তর - এর এক-দেড়শো খুচরো লেখার কোনো হদিশ নেই । এমনকি  খান দশেক গল্পের ও কোনো সন্ধান নেই ।
দুটো গল্পের জন্য খুব কষ্ট হয়। একটা ---কৃষিকাজ থেকে পশুপালন,  অন্যটি ---দখল। কৃষিকাজ থেকে পশুপালন গল্পটির জন্য হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন ও দিয়েছি প্রায়। আমার ধারণা ছিল কবি রাজকল্যাণ চেল-এর কাছে পাওয়া যাবে । রাজকল্যাণ ও দিতে পারেনি  । পেলে একটা ছোটগল্পের বই করা যেত।
দেখতে পাচ্ছি সুন্দরের দিকে লেখাটি বেশ  অনেকে পড়ছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ যদি ওই গল্পটির কপি দিতে পারেন তাহলে খুবই উপকৃত হব।

শ্যামলদা শেষ সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। আমাকে আরো গল্প লিখতে হবে।
লেখার ব্যাপারে আমার কোনো সমস্যা নেই । লেখার আমন্ত্রণ পেলেই লিখে ফেলি।তবে পত্রিকার ব্যাপারে  একটা নির্বাচন থাকে । কোন পত্রিকায় লিখবো আর কোন পত্রিকায় লিখবো না ---সেটা আগে নির্ধারণ করে নিতে হয়। পছন্দের পত্রিকায় লেখা দিতে দেরি করি না। এই যেমন বুধবার নাসের বলল, ঘাট পেরিয়ে -র জন্য কবিতা দিতে হবে। বিষয়টি  আমার কবিতাতে মেলানো যাবে না মনে হওয়ায় ফেসবুকে সম্পাদক গোপাল বাইন-কে ধরে বললাম---গদ্য লিখতে চাই । গোপাল ইয়েস করলো।বললো নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে।
আমি শুভস্য শীঘ্রই নীতিতে বিশ্বাসী । তখনি শুরু করলাম লেখা । গতকাল সন্ধেতে নাসেরের হাতে ধরিয়ে দিলাম লেখাটি।গতকাল ছিল নভেম্বরের ২ তারিখ ।
আমার মত হল---লেখা যখন দিতেই হবে, আর হাতে যখন কলম আছে, তখন অহেতুক দেরি করবো কেন।
নিখিল -নীলিমার পত্রিকা নিনি-র ক্ষেত্রেও এমনটাই করি।
অতীতের সঙ্গে বর্তমান মিশে গেল। তাতেই বা কী এমন ক্ষতি হল।
বর্তমানের কি সুন্দরের দিকে-র মধ্যে প্রবেশাধিকার নেই। কোথায় লেখা আছে ? লেখা থাকলেও আমি তা মানতে বাধ্য নই ।





৬২•দ্বিতীয় পর্ব

যাঁরা ভাবছেন আমি আদাজল খেয়ে নেমেছি শ্যামল -বন্দনায়। তা খুব একটা অন্যায় বলছেন না ।তবে আদাজলের সংযোজনের কোনো প্রয়োজন দেখছি না । বরং আদার পরিবর্তে নুন ব্যবহার শ্রেয় তথা সহজলভ্য । নুন খেয়ে গুণ গাওয়া স্বাভাবিক । যাঁরা গুণ গান না তাঁদের  নিমকহারাম বলে হয়ে থাকে । নিমক তো নুন-ই। আর হারাম-এর অর্থ বলাটা জরুরি নয়।
শ্যামলদার প্রশ্রয় না পেলে আমি  অপূর্ণ থাকতাম। লিখতে গেলে সাহস লাগে। একথা শ্যামলদা মুখ ফুটে কখনোই বলেননি। আমি শ্যামলদার অনুচর হিসেবে বুঝে গিয়েছিলাম নিজে নিজেই। বড়ো লেখার জন্য সাহসই মূলকথা । লেখা আরম্ভের আগে দরকার  আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাস বা আত্মনির্ভরতা শ্যামলদার মধ্যে ছিল ।
আমার প্রিয় এক নবীন কবি বন্ধু বলেছিল একদিন  যে আমার কনফিডেন্স নাকি আনপ্যারালাল। ঠিক তা-ই।আমাকে ঠিক পড়তে পেরেছিল সেই নবীন কবি । আমার মতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে  আর কেউ লেখে কিনা আমার জানা নেই । এরকম একটা ঘটনার বিবরণ পড়তে থাকুন।

কোনো একদিন শ্যামলদা বললেন এবারের পুজো সংখ্যায় তোকে উপন্যাস লিখতে হবে । সেদিনের তাপমাত্রা কত ছিল জানি না, বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণও জানা নেই । শুক্লপক্ষ না কৃষ্ণপক্ষ তাও মনে আসেনি । শুধু শুনেছিলাম পুজো সংখ্যায় উপন্যাস । অমৃত শারদীয়া সংখ্যায় উপন্যাস ।
আমি শুধুমাত্র সম্মতি জানিয়ে বলেছিলাম, লিখবো।
এই কথাটা বলার সাহস আমার ছিল । তা আমি অর্জন করেছিলাম শ্যামলদার কাছ থেকেই । কী লিখবো কিছুই জানা নেই ।শুধু জানতাম যে কোনো সময়ে বসলেই লেখাটা হবে যাবে। পুজো সংখ্যাগুলিতে যেসব উপন্যাস প্রকাশিত হয় তা আমি বাঁহাতে লিখে ফেলতে পারি।এর থেকে সহজ কাজ আর কিছু হয় না ।
সেই লেখাটা  আমাকে কেমন সমস্যায় ফেলেছিল তার বিবরণ দেবো আগামীকাল ।
আজ এখুনি মুজরো করতে যেতে হবে।





৬৩•দ্বিতীয় পর্ব

শ্যামলদা একটা বড়ো গাড়ি কিনেছিলেন । ভক্স ওয়াগান।বেশ বড়ো। আমাদের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের সঙ্গে খাপ খেত না । শ্যামলদা বলতেন গাড়িটা পুরোনো হতে পারে, কিন্তু  ইঞ্জিন সচল। সত্যিই তা-ই ছিল । রাস্তায় কোনোদিনই বিগড়ে যায়নি । অর্থাৎ ঠেলতে হয়নি। ঠেলতে হলে অবস্থাটা কী হত, তা ভাবলে মাথা ঘুরে যায়। ওই গাড়ি নাড়াবার সাধ্য ছিল না  আমার । ঠেলা অনেক দূরের চ্যাপ্টার ।
তো  একদিন প্রাতকালে সেই গাড়ি এসে উপস্থিত হল  আমার গৃহের সন্নিকটে ।
এই বাক্যটি লিখলাম গাড়িটির আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য ।
শ্যামলদা হাঁক দিলেন, বেরিয়ে আয়। অজিতেশের বাড়িতে নেমন্তন্ন  আছে।অজিতেশের বউ রান্না করে অপেক্ষা করছে ।
অজিতেশ অর্থাৎ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশিষ্ট নাট্য -ব্যক্তিত্ব। যাঁর প্রায় সব নাটকের দর্শক আমি । নানা রঙের দিন, মঞ্জুরি  আমের মঞ্জুরি, শের আফগান ---সবই দ্যাখা ছিল ।
অজিতেশ থাকতেন নারকেলডাঙার দিকে । গাড়ি তখন মৌলালিতে। নতুন ফ্লাইওভার হয়েছে সবে। এর আগে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাওয়া হয়নি । বেশ নতুন নতুন লাগছিল । সেই নতুন লাগাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। শ্যামলদা জানতে চাইলেন পুজো সংখ্যার উপন্যাসটি সম্পর্কে । কারণ যুগান্তর -এ তখন প্রতিদিনই বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে ---
শারদীয়া অমৃত-তে  উপন্যাস লিখেছেন -- আশাপূর্ণা দেবী আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রফুল্ল রায়  শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রভাত চৌধুরী । ২৪ পয়েন্ট টাইপে এই নামগুলি ছাপা হত । দু ইঞ্চি -পাঁচ ইঞ্চির কবিতালেখকের নাম বিজ্ঞাপনে। ভাবা যায়  না । যুগান্তর ছাড়া ও বিজ্ঞাপিত হচ্ছে রেডিও তে।
এই অবস্থায় আমার উত্তর দেওয়া টা জরুরি । আমিও কম যাই না । বানিয়ে বানিয়ে বলে যেতে থাকলাম। গাড়ি তো আর থেমে থাকেনি ।
ফ্লাইওভার ঠিক যেখানে শেষ হয়েছে, শ্যামলদা মোলায়েম করে বললেন, তুই এক লাইনও লিখিসনি। তাই তো।
আর কোনো কথা নয়।শ্যামলদার মাথার মধ্যে তখন শুরু হয়েছে  আমার লেখা নিয়ে ।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পা দিয়ে বললেন ভালো করে খাস কিন্তু । না হলে আমার বদনাম হয়ে যাবে ।
ঘরে ঢুকতেই অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাণখোলা  উন্মাদনা । আনন্দ -প্রকাশের এহেন দৃষ্টান্ত আমি খুব বেশি দেখিনি । আমি আদৌ আমন্ত্রিত ছিলাম কিনা  এখনো জানি না, তখনো জানতাম না । কিন্তু সেদিন মাননীয় অতিথি হিসেবে গণ্য হয়েছিলাম ।
খাদ্য তালিকা বা মেনুকার্ড জানানো জরুরি নয়। তবে দু-রকমের মাছ, মাংস যে ছিল সেটা না জানালে পাপ হবে, তাই জানালাম ।
ফেরার পর সোজা আমার ঘরে । তখন দোতলার মাঝের ঘরে থাকতাম । যূথিকা কে ডেকে ঘরের তালাচাবি নিয়ে আমাকে গৃহবন্দি করে দিলেন শ্যামলদা । যূথিকার হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললেন যা খেতে চাইবে, তা-ই খেতে দেবে। বাথরুমে যাবার প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে আমি পা ভেঙে দেবো। যূথিকা  এবং আমি দুজনেই জানতাম, পা ভেঙে দেওয়াটা কথার কথা ছিল না। সত্যিই উপন্যাসটি না লিখলে আমাকে ভাঙা-পা নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হত।




৬৪•দ্বিতীয় পর্ব

শ্যামলদার নির্দেশ আমি অমান্য করিনি । কথা বলার ধরণটা ঠিক হয়নি । লিখতে হত---শ্যামলদার কোনো কথা বা নির্দেশকে অমান্য করার কোনো সাধ্য ছিল না  আমার । এতটাই নির্ভরতা ছিল। এখনো আছে।
এখনো আছে, একটি বিতর্কিত কথা। আমি আদৌ এনিয়ে তর্কে যেতে চাইছি না । আমার বিশ্বাস আমার  আঙুলেই বিরাজ করুক। এনিয়ে কথা চালাচালি আমার কামনা নয়।
লেখাটা শুরু করাটা জরুরি ছিল । আমরা যারা লিখতে ভালোবাসি তারা লেখাটা শুরু হবার পর লেখাটা  এগোতে থাকে । লেখাটি নিজেই নিজের গতিপথ এগোতে থাকে । এই প্রসঙ্গে আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানিয়ে রাখি ---লেখাটা যেভাবে বা যেদিকে নিয়ে যাবার পরিকল্পনা থাকে, লেখার পর বুঝতে পারা যায়, পরিকল্পনা মতো লেখাটা লিখতে পারলাম না । কিছুটা অন্যরকম হয়ে গেল ।
আমার লেখার ওপর কে খবরদারি করলো, তার কোনো সন্ধান পাইনি । এর জন্য কোনো অভিযোগ কিংবা অনুযোগ নেই ।
লেখার সময়ে ধরে নিতে হবে এই নির্দিষ্ট লেখাটির লেখক পুরোপুরি আমি নই। আমার সঙ্গে  আরো একজন আমি আছে। যাকে প্রকাশ্যে দ্যাখা যায় না । কিন্তু তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। একে কেউ কেউ সাবকনস্যাস রূপে চিহ্নিত করেন। আমার ভিন্ন চিন্তা । আমার বিশ্বাস আমার ভেতরে যে অবস্থান করে সে সুপারকনস্যাস। কারণ সে-ই তো আমাকে চালিত করে । আমার থেকে শক্তিশালী না হলে সে কীভাবে আমাকে চালিয়ে নিয়ে  যায় বা নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এসব কথা এখন তোলা থাক ।
যে কদিন লেখাটা অর্থাৎ অমৃত পুজো সংখ্যার লেখাটা শেষ না হয়েছিল ততদিন একবারের জন্যও বাড়ির বাইরে পা রাখিনি ।
খাদ্য এবং পাণীয় -র যোগান ঠিকঠাক ছিল ।কাজেই বাইরে যাবো কোন আহ্লাদে ।
লেখা যেদিন জমা দিলাম সেদিন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মনে হয়েছিল ।
লেখাটার একটা নাম দিয়েছিলাম, ছাপার পরে দেখলাম, লেখাটির নাম দুঃখের পায়রা।
পয়রা লয় মা, পাখি লয় মা টুসু খেলা করে গো।
নামে কীবা এসে যায়। আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে তখন টুসুগান।
শারদীয়া অমৃত-তে উপন্যাস প্রকাশের পর আমি প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে বিবেচিত হলাম। ফলে আমার উচ্চতা যে একলাফে ছ- ইঞ্চি বেড়ে গিয়েছিল যাঁরা ভাবছেন তাঁদের ভাবনাতে গলদ আছে । পাঁচ ফুট ছ- ইঞ্চির প্রভাত চৌধুরী সেই পাঁচ ফুট ছ-ইঞ্চিরই ছিল ।

এর কিছুদিন পর শ্যামলদা  আদেশ করলেন ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে হবে।
আগেই বলেছি শ্যামলদার কোনো আদেশ বা নির্দেশ  অমান্য করার কোনো সাধ্য আমার নেই ।
আমার  অবস্থা হল --- খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল তার হেলে গোরু কিনে।




৬৫•দ্বিতীয়া পর্ব

দু-ইঞ্চি, তিন-ইঞ্চির কবিতালেখক কপালজোরে আট-দশ ইঞ্চির গদ্য লিখতে শুরু করেছি সবে। শ্যামলদার কাছ থেকে পা-কে রক্ষা করার জন্য পুজো সংখ্যায় উপন্যাস লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম ।
পা অক্ষত রাখতে পেরেছিলাম । তখন  অন্য রকম ছিল । আর পুজোর উপন্যাস প্রকাশের পর হেভেন এন্ড হেইল পার্থক্য । এখন আমি কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠিত ।
আমি সবসময়ই মনে রাখতাম আমার লেখার ওপর শ্যামলদার সম্মান জড়িয়ে আছে । এমন কোনো লেখাই লেখা চলবে না যাতে শ্যামলদার অসম্মান হয়। এই একটি ব্যাপারে আমার তালে ভুল হত না । এ যেন শ্যামলদাকে অনেক অভিযোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লেখা ।
লেখার বিষয়ে কথা বলে নিতে হবে। শ্যামলদার  অনুমতি পেলেই লেখাটা শুরু করা যাবে ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা টাকা তোলার জন্য অনেকগুলি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিলাম কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে । এরমধ্যে একটা হয়েছিল আমাদের পাড়াতেই । হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ।
আমার বিশেষ অনুজ বন্ধু ভানু বা অশোক চট্টোপাধ্যায় ছিল মূল সংগঠক।
এই অনুষ্ঠানে  অধুনা বাংলাদেশের বিশিষ্ট রবীন্দ্র -গায়িকা সনজিদা খাতুন গান গেয়েছিলেন ।আর ছিলেন রফিকুল ইসলাম, বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী।
এই মঞ্চে সনজিদা খাতুনের হাতে অনেকেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন ।
একজন নিজে টাকা দিতে অস্বীকার করেছিলেন । বলেছিলেন --- আমি টাকা দিলে তোমার বদনাম হবে।তিনি আমার একান্ত প্রিয় সাবি দি। সাবিত্রী দি।
তিনি থাকতেন কালীঘাট ব্রিজের পাশে একটা দোতলা বাড়ির একটা সাত বাই সাত খুপরি ঘরে । ওই ঘরে  আমার যাতায়াত ছিল ।
সাবি দি রা ওই ঘরে ব্যবসা করতো, দেহ ব্যবসা ।
এখন যাঁদের যৌনকর্মী বলা হয়।
কালীঘাটের বিভিন্ন যৌনকর্মীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন সাবি দি রা। দেহবেচা টাকা । তাও আবার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ।
আমার এবং ভানু-র অনুরোধে ওই টাকা সংগ্রহ হয়েছিল ।
আমি জোর করে সাবি দি কে মঞ্চে তুলেছিলাম । কই আমার তো কোনো বদনাম হয়নি। বরং আমি  আদৃত হয়েছিলাম ।
কেবলমাত্র কালীঘাটের ওই বাড়িতেই নয় আমার যাতায়াত ছিল প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের একটি বাড়িতে । ওই পাড়াকে হাড়কাটা গলি বলা হত। ওখানে আমার সঙ্গী ছিল সরস্বতী । ওর ঘরে  আমরা একদল কবি -লেখক প্রায় নিয়মিত আড্ডা দিতাম বা মদ্যপানের আসর বসতো। কারা সেই আসরে যেত তার তালিকা প্রকাশ খুব জরুরি নয়। তবে একথা তো বলতেই পারি, আমার সেই সময়ের সঙ্গীরা সকলেই যেত। এখন যে যাঁর মতো নামের লিস্ট বানিয়ে ফেলুন। আমি কিন্তু কারো নাম করলাম না ।

একদিন গাড়িতে ফেরার পথে শ্যামলদাকে লেখার বিষয়ে বললাম।শ্যামলদা দুহাত তুলে সমর্থন করলেন।
বাড়ি ফিরে শুরু করে দিলাম ---
সতীসাবিত্রী কথা।




৬৬•দ্বিতীয় পর্ব

সতীসাবিত্রী কথা লেখাটা শুরু করে দিলাম । এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র একটি বাড়ি। এই বাড়ির অবস্থান কালীঘাট ব্রিজের নীচে বা পাশে। এটা আগেও লিখেছি । কিন্তু যা লেখা হয়নি তা হল পার্শ্বচরিত্রদের নাম-ধাম।
এই চরিত্রগুলির মধ্যে (পার্শ্ব শব্দটি বর্জন করলাম ) প্রমীলা বা বাড়িউলি অন্যতম প্রধান চরিত্র । সাবিত্রী বা সাবি দি ওই বাড়ির থেকে তুলে আনা চরিত্র ।
সতী নবাগতা।কলকাতার এক ব্যবসায়ী পরিবার থেকে চলে আসা এক নারী । এই চরিত্রটির মধ্যে কল্পনা মিশিয়ে ছিলাম।  
বীণা থাকতোটালিনালা বা আদি গঙ্গার ওপারে । সরস্বতী -র ঘর বা ব্যবসা ছিল হাড়কাটা গলি বা প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের একটা বাড়িতে ।
আমি এইসব চরিত্র গুলিকে এক ছাদের নীচে নিয়ে এসেছিলাম । শুধুমাত্র এখানেই আমার কৃতিত্ব ।
আসলে রেডলাইট  এলাকা নিয়ে বাংলাভাষায় কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি । আন্তর্জাতিক মানের ছোটো গল্প লিখেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র সমরেশ বসুর মতো কালজয়ী লেখকেরা । আর আমার মতো নেহাতই একজন নগন্য লেখকের চাঁদ ধরার বাসনা হল। শ্যামলদার মতো আর একজন মহৎ লেখক তার সমর্থন করলেন। প্রশ্রয়ও দিলেন । আমি ছিলাম  নিরুপায়। লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম ।
আমি বিশ্বাস করতাম, আমার বাড়ি কালীঘাটে, আমার  অধিকার আছে সতীসাবিত্রী কথা লেখার । এই বিশ্বাস  এবং শ্যামলদার উৎসাহ একত্রিত না হলে এই লেখাটা লিখতে পারতাম না  আমি ।
এই লেখার  অনেক ঘটনার সঙ্গে  আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যুক্ত ছিল ।
অনেক কথা লেখা যায় না, কখনোই লেখা  উচিত নয়।কিন্তু না -লেখাটা দোষণীয় হবে । বদনাম হবে,  এই অজুহাত দেখিয়ে সরে আসবো, সেটা আমার কাছে ঘোরতর অন্যায় হবে । সত্য থেকে সরে আসতে যাবো কেন? কার ভয়ে?
আর এই বয়সে পৌঁছে বদনাম নামক একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে এতটা গুরুত্ব দেবো কেন?
আমি কীভাবে অস্বীকার করবো সাবি দি দুপুরে মাংস রান্না করলে একবাটি মাংস তুলে রাখতো রাত্রে আমি খাবো বলে। আর সরস্বতীর বাড়িতে যখন কবিলেখকদের নিয়ে মদের ফোয়ারা তুলতাম তখন তো সরস্বতীর তিন-চার ঘণ্টা ব্যবসা বন্ধ থাকতো। কই সরস্বতী তো কোনোদিনই এই বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেনি । কোনোদিনই হাত পেতে কোনো টাকা দাবি করেনি । আমি যা দেবার ওর বালিশের নীচে রেখে এসেছি ।
এসবের কি কোনো মূল্য নেই । আমার বদনাম টা বড়ো হয়ে যাবে ।
আমি যা আমি তা-ই। আমার কোনো বানানো আমি নেই। আমি নিজেকে  এভাবেই দেখি এবং দেখাতে চাই ।



৬৭•দ্বিতীয় পর্ব

গতকাল একজনের নাম লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম । এটা বেশ অন্যায় হয়ে গেছে । সে আমার কালীঘাটের অনুজ বন্ধু । অনাথ ।
1 এবং 1 A বাস গুমটির টাইম কিপার । অনাথ আমাকে জানিয়েছিল  ওই বাড়ির একজনের নমাজ পড়ার কথা। আমি সুযোগ মতো সতীসাবিত্রী কথা-য় জুড়ে দিয়েছিলাম মাত্র । ওই লেখাটার অনেক কথাই বাসিন্দারা জানিয়েছিল। আমি আমার গদ্য ভঙ্গিতে সেগুলিকে লিখে গেছি , এর বেশি কিছু নয়।
ফেসবুকে দেখছি  আমার সেই পর্বের স্বজনেরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। খুবই ভালো লাগছে । আরো ভালো লাগতো যদি তুষার চৌধুরীকে এই লেখাটি পড়ানো যেত।তুষার কোথায় গেছে তা জানি। কিন্তু নির্দিষ্ট পিনকোর্ড জানি না ।জানলে জ্যোতির্ময়-কে বলতাম লেখাটার PDF কপি তুষারকে পাঠিয়ে দাও।  
যা হবার নয় তা নিয়ে ভাবাটা ঠিক নয়।কিন্তু তুষারের প্রসঙ্গ  উঠলে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না । কেমন যেন অসহায় লাগে নিজেকে ।কবিতা পাক্ষিক - এর প্রথম দিকে তুষার ছিল  সঙ্গে ।তুষার তুষারের মতো করেই ছিল । নাসের শান্তনু রজতেন্দ্র সুমিতেশের মতো করে নয়।
একদিনের একটা ঘটনার কথা  উল্লেখ করছি, বিশেষ কিছু বোঝানোর জন্য ।
সেদিন  অফিস থেকে হেঁটেই আসছিলাম সরস্বতীর বাড়িতে ।বহু বাজার মোড়ের কাছে দেখা হয়ে গেল এক সহকর্মীর সঙ্গে । আমার থেকে অনেকটা জুনিয়র । শান্তি । বিষ্ণুপুরের দিকে বাড়ি।P S C দিকে এসেছে।পরে  WBCS দিয়ে অন্য চাকরিতে চলে যায়।সেটা অন্য প্রসঙ্গ ।শান্তি সম্পর্কে আর মাত্র একটা কথা --- শান্তি বেশ ভালো বাউলগান গাইতে পারতো।
এহেন শাস্তি যখন চাইলো--- কোথায় যাচ্ছেন । আমার উত্তর ছিল সপ্রতিভ।
--- হাড়কাটা গলিতে, সরস্বতীর বাড়ি। তুমি যাবে?
--- আমাকে নিয়ে যাবেন ? শান্তির জিজ্ঞাসা ।
---কেন নিয়ে যাবো না।তোমার মতো অনেককেই নিয়ে গেছি ।চল---বলে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম সরস্বতীর বাড়িতে।
শান্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম সরস্বতীর ।সরস্বতী জিগ্যেস করেছিল, চা খাবেন তো।
বুঝতে পারছিলাম সরস্বতীর ঘরে ঢুকে ও একেবারেই ঘাবড়ে গেছে।কোনো ক্রমে সম্মতি জানিয়েছিল ।
চা-পান শেষ হবার পর শান্তি কে বলেছিলাম--- এবার তুমি বাড়ি যাও।আমি  এখন সরস্বতী কে আদর করবো।
শান্তি আর এক মুহূর্ত ও অপেক্ষা করেনি ।চোখ বন্ধ করে দৌড় লাগিয়েছিল।
আর সরস্বতী  আমার জন্য সাজিয়ে দিয়েছিল গ্লাস -বোতল-জল  ইত্যাদি ।
আমি নিমগ্ন হয়েছিলাম আমার প্রাত্যহিকতায়।

পরদিন শান্তি জানিয়ে ছিল  ওরাও তো মানুষের মতোই।
আমার বলা হয়নি সেদিন,  আজ মনে হচ্ছে আমার বলা উচিত ছিল --- মানুষের মতো মনে হল, কবে মানুষ মনে হবে।




৬৮•দ্বিতীয় পর্ব

আমার এবং সরস্বতীর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবো তা আমার জানা নেই ।সরস্বতী কি আমার ভালোবাসার নারী ছিল ? তাও স্পষ্ট করে জানাতে পারছি কই ।
ভালোবাসা কাকে বলে সেটাও ভালো বুঝি না ।তবে ভালোবাসায় কোনো খামতি নেই আমার । অনেককে ভালোবাসি । আলাদা করে কাউকে চিহ্নিত করতে পারি না । এখানেই আমার  অক্ষমতা ।
সরস্বতীর প্রতি যদি  আমার আকর্ষণ না থাকতো, তাহলে ছুটে যেতাম কেন দিনের পর দিন ।শুধু যে নিজে যেতাম  এমনটাই নয় প্রিয়জনদেরও সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
সরস্বতীর ঘরটিকে কি আমি কেবলমাত্র মদ্যপানের  জন্য ব্যবহার করতাম। তা কেন হবে , আমি তো সরস্বতীর শরীরও ব্যবহার করেছি। সরস্বতীর প্রলোভনে নয়।নিজের চাহিদায়।
এমন একটি মাত্র ঘটনার কথা লিখছি যা না লিখলে অন্যায় হবে।
একদিন  আমি সরস্বতীর সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম, তখন হঠাৎই লোডশেডিং হয়ে যায়।সেদিন  আমার সঙ্গী ছিল তরুণ দুই লেখক । তারা দুজন দুদিক থেকে আমাদের বাতাস করেছিল, হাত পাখা দিয়ে । এমন জনশ্রুতিও আছে । আমি  এই ঘটনা ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারি না ।যা ভুলতে পারি না, তা লিখতে বাধা কোথায়। আমার ক্যারেকটর সার্টিফিকেটের জন্য আমি কারো কাছে কোনোদিনই যাইনি, আজও যাবো না ।
আমি আমার নিজের স্বার্থে, লেখার স্বার্থে যতদূর যেতে হবে, ততদূরই যাবো। তার থেকে এক-পা কম যাবো না।
কিছুটা বাড়াবাড়ি করে বসলাম । এই লেখার পাঠকরা আমাকে মার্জনা করবেন। একথা  আমাকে লিখতে হতই। অনুপম কাহিনি -তে লিখেছি , সতীসাবিত্রী কথা-য় লিখেছি। তবে সেখানে নিজের নামের পরিবর্তে  অনুপম- এর নাম লিখেছিলাম । এবার প্রথম আমিত্ব বজায় রাখলাম । অনুপম কাহিনি -র অনুপম তো আমি ছাড়া আর কেউ নয়। এটা তো লেখার অক্ষরে ছাপা  আছে, যাঁরা পড়ার তাঁরা পড়েছেন।

সতীসাবিত্রী কথা-য় শুরুতে যা ছাপা আছে তা একবার পড়ে নিতে অনুরোধ করছি ।
কলিতীর্থ কালীঘাটের এক অপবিত্র বাড়িতে বাস করে সাবিত্রীরা।ব্যবসাও করে।মূলধন তাদের রূপ ও যৌবন। এ বাড়িতে সুখ কিনতে আসে ব্যবসায়ী উকিল সিনেমাওয়ালা কবি থেকে শুরু করে পুলিশ মাস্তান রেস্তরার বয়----সকলেই আমাদের পরিচিত ।নতুন আসা  এক নারী নিজের নামকরণ করে সতী।
এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রাককথন।প্রতিটি চরিত্র  আমার অতি পরিচিত । আর সেকারণে এই লেখাটিকে রিপোর্টাজ হিসেবেও পড়া যেতে পারে । অথবা যদি বলি এটি ডকুমেন্টারি রচনা তাহলেও খুব একটা ভুল হবে না ।
লেখা টা যখন অমৃত-তে প্রকাশিত হচ্ছে সেসময় বইমেলা চলছিল ।লেখাটা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে বইমেলার গেট থেকে স্টল পর্যন্ত পৌঁছতে কমপক্ষে  আট-দশ জনকে জানাতে হয় পরের পর্বে কী হবে।
বইমেলার স্টল মানে তিনসঙ্গী -র স্টল। সেখানে পৌঁছনোর জন্য তো আগে যেতে হবে।
তার জন্য  আগামীকাল ।




৬৯•দ্বিতীয় পর্ব

তিনসঙ্গী নিয়ে বলতে গেলে শুরু করতে হবে এলাহবাদ   ব্যাঙ্কের কলেজ স্ট্রিট ব্রাঞ্চ থেকে ।সমীর চট্টোপাধ্যায়,  আমাদের কবিপত্রর সমীর তখন ওই ব্রাঞ্চে চাকরি করতো ।মূলত সমীরের উদ্যোগ  এবং তৎপরতার জন্য জন্ম হয়েছিল তিনসঙ্গী নামক সংস্থাটি । এই তিনসঙ্গী-ই ছিল কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় আমার প্রথম বসার বা দাঁড়াবার জায়গা ।
মূল প্রকল্পটি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মস্তিষ্ক প্রসূত।
সমীর ছিল তার প্রধান রূপকার। আর আমি ছিলাম সব ঘটে মানিয়ে যেতে সক্ষম  এমন একটি কাঁঠালি কলা।
কলেজ রো-র দোকানঘরের ব্যবস্থা করেছিল সমীর । আমার ওপর দায়িত্ব ছিল  ওটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে তোলা। অর্থাৎ ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের কাজটা ঠিকঠাক ভাবে করানো। এক ফালি জায়গা, তাকে দোকানে রূপদান করা খুব একটা সহজ ছিল না ।আমার বন্ধু হীরক দাশ -এর  ভাই দিলীপ সেই দায়িত্ব নিয়েছিল বা তাকে আমরা দায়িত্ব অর্পণ করেছিলাম ।
এই আমরা ব্যবহারের কারণ তখনই  আমি তিনসঙ্গী -র এক সঙ্গী হয়ে পড়েছি । আমি আদতে তিনসঙ্গী -র তিনজনের একজন ছিলাম না । অথচ বাজারে চালু ছিল তিনসঙ্গী -র অন্যতম  একসঙ্গী আমি । এই চালু কথাটির কোনো বিরোধিতা তখন করিনি ।কারণ আমি তখন বিরোধিতা শব্দটিকে চিনতাম না । আমি ইয়েস ম্যান ছিলাম, শ্যামলদার  ইয়েস ম্যান । আমি শ্যামলদার হয়ে প্রক্সি দিতাম। এর বেশি কিছু নয়।
সমীরের ব্রাঞ্চে চাকরি করতো গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়। পি ও হিসেবে যোগ দিয়েছিল সবে।গৌতমের জেঠা অজিত গঙ্গোপাধ্যায় বিশিষ্ট নাট্যকার । গৌতমও  আপাদমস্তক সাহিত্য প্রেমী।
গৌতম তার মায়ের প্রতিনিধিত্ব করতো।যেমন সমীরও তার মায়ের হয়ে মালিকানা প্রাপ্ত। আর আমি প্রভাত চৌধুরী ছিলাম শ্যামলদার স্ত্রী  ইতি বউদির প্রক্সি -প্রতিনিধি ।
কবিপত্র -কালে সমীর একটা পত্রিকা সম্পাদনা করতো তার নাম ছিল সংক্রান্তি । ব্যান্ডেলে বাড়ি। সেন্ট্রাল  এভিন্যিয়ু লাগোয়া একটা মেসে থাকতো।তুষার এবং আমি মাঝেমধ্যে ওই মেসে আড্ডা দিতে গেছি ।
সেসব  অ-কথা আ-কথা বলে কালক্ষেপ অর্থহীন ।
বরং ঘটনার ঘনঘটায় প্রবেশ করা যাক ।
হীরকের ভাই দিলীপ তিনসঙ্গী -র ঘরটিকে প্রকৃত সুন্দর এক দোকানঘরের মতো করে দিল।মালিকদের পছন্দ হল।তিনসঙ্গী-র কর্মচারী নিয়োগ করা হল।তাঁর নাম মনে নেই, আমরা মেজদা বলে ডাকতাম ।মেজদার  একটা বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁকে একশো টা নোট গুনতে দিলে কিছুতেই ছ- এর ঘর পার করতে পারতেন না ।
আজ শোবার সময় হয়ে গেল।লেখাটা ছোটো হল,  আগামীকাল বেশি লিখে জবাব দেবো।




৭০•দ্বিতীয় পর্ব

সেই বিশিষ্ট পয়লা বৈশাখ দিয়ে  আজকের কিস্তি শুরু করছি । এই পয়লা বৈশাখেই তিনসঙ্গী-র  উদ্বোধন হয়েছিল ।
আমার  ওপর দায়িত্ব ছিল গণেশ পুজো করিয়ে নিয়ে যাওয়া । আমার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতেই সেই পুজো হয়েছিল ।পুজো করেছিলেন বিশিষ্ট পুরোহিত পিনুদা বা অমল চট্টোপাধ্যায়।যিনি ম্যাডাস স্কোয়ারের দুর্গা পুজো করতেন । কাজেই বুঝতে  অসুবিধা হচ্ছে না যে আয়োজন নির্ভুল ছিল ।
ভোরভোর পুজো শেষ করে নতুন লাল শালুতে বেঁধে গণেশ ঠাকুর এবং পুজোর ফুল-বেলপাতা সহ সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছিলাম কলেজ রো-র দোকানে।
সেদিন কি আমাকে বড়ো বাজারের ব্যবসায়ীদের মতো মনে হচ্ছিল কিনা বলতে পারবো না ।মনে হলেও তখন বিচার করার পর্যায়ে ছিলাম না আমি। এতটাই তিনসঙ্গী নিয়ে মাতোয়ারা ছিলাম। আমাদের নতুন দোকান হল,  এই আনন্দেই বিভোর ছিলাম ।
এই প্রসঙ্গে কবিতা পাক্ষিক -এর পটলভাঙার ঘরের উদ্বোধনের সময়ে কিন্তু গণেশ পুজো হয়নি।কবিলেখকদের জমায়েত হয়েছিল ।
সেই প্রসঙ্গ পরে লেখার সুযোগ পাবো।এখন কেবলই তিনসঙ্গী -কথা ।
তিনসঙ্গী এবং পয়লা বৈশাখের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জগন্নাথ হোটেল কে।আগেকার কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের পেছনের দিকে ছিল জগন্নাথ হোটেল। ওই হোটেলে রীতিমতো গুঁতোগুতি করে চেয়ার দখল করতে হয়েছিল । কেবলমাত্র সেবারই নয় যতবার পয়লা বৈশাখ পেয়েছি তিনসঙ্গী -কালে ততবারই জগন্নাথ হোটেল । দুপুরে বাড়ির মিল অফ করে চলে আসতাম কলেজ রো-র এক চিলতে ঘরে ।
প্রথম পয়লা বৈশাখে প্রকাশিত হয়েছিল শ্যামলদার  চন্দনেশ্বর জংশন এবং গল্পসমগ্র-র প্রথম খণ্ড ।তার সঙ্গে  আশাপূর্ণা দেবী-র একটা উপন্যাস ও ছিল । তখনকার দেশ সাপ্তাহিক পত্রিকার পরপর দুটি সংখ্যাতে এক কলাম করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল । সেই প্রথম শ্যামলদার বইয়ের এত বড়ো বিজ্ঞাপন দেশ- এর পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল ।
তখন বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হত আর্টপুল। বা আর্টপেপারে বিজ্ঞাপনের ম্যাটার রেডি করে দিতে হত। সেসব কাজ করতো সমীর।সঙ্গে  আমিও থাকতাম ।
সেই সময়ে নতুন বই প্রকাশের তারিখ ছিল পয়লা বৈশাখ ।এখনকার মতো বইমেলা নয়। বইপাড়ায় পয়লা বৈশাখ গমগম করতো।সমস্ত লেখকরা পৌঁছে যেতেন বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার ঘরে বা দোকানে ।সেখানে  আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল এলাহি।
আমাদের তিনসঙ্গীও সে ব্যাপারে পেছিয়ে থাকেনি।থাকবেই বা কী করে।মাথার  ওপর শ্যামলদার মতো বড়োমনের মানুষ বসে ছিলেন তো। আমাদের কোনো সাধ্য ছিল না মান-কে নীচে নামাতে।আর নামাতেই বা যাবো কেন। আমাদের কাছে কি গুড উইলের কোনো মূল্য ছিল না ।
সেদিন বিকেল থেকে যে নক্ষত্র সমাবেশ হয়েছিল তিনসঙ্গী তে তার তুলনা হয় না ।সব নাম মনে থাকার কথা নয়, মনেও নেই ।তবু যতটুকু স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারে ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।   এবার বলা যাক নামগুলি ।তিনসঙ্গী-র পক্ষে উপস্থিত ছিলাম ---শ্যামলদা সমীর গৌতম তুষার চৌধুরী পবিত্র মুখোপাধ্যায় এবং আমি।আমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন ----জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী অমিতাভ চৌধুরী মতি নন্দী বরেণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রফুল্ল রায় অমর মিত্র শচীন দাশ  সহ আরো অনেকেই । বুঝতে পারছি নামের লিস্ট থেকে বেশির ভাগ নাম বাদ গেল।তবু আমি নিরুপায়। সমীর কে ফোন করলে হয়তো আরো কিছু নাম উদ্ধার হত।কিন্তু সমীরের ফোন নম্বর নেই। রাখার কোনো প্রয়োজন নেই বলে রাখিনি ।
সেদিন যেসব দোকান থেকে বই নিতে এসেছিল তারও কিছুটা মনে আছে।
দে বুক স্টোর থেকে এসেছিল তপন, এখন যে স্বপন আছে , তার দাদা তপন। সমীর নাথ দের তখন একটিই দোকান।নাথ ব্রাদার্স ।ওদের প্রতিনিধি র নাম ভুলে গেছি ।
সেদিন কি আমার  ওপর ক্যাশমেমো লেখার দায়িত্ব  ছিল ? মনে নেই ।

সব শেষ হবার পর আমি নিজেকে যুদ্ধ -জয়ী মনে করেছিলাম ।কেন করেছিলাম জানি না ।হয়ত বা অকারণে এবং অহেতুক ।




৭১•দ্বিতীয় পর্ব

তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম । আমার ঘোরের মধ্যে থাকাটা কোনো নতুন উপসর্গ নয়। যখন যেটা করি, সেই করার মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পণ করি। তা মাছধরা হোক কিংবা তাস খেলা হোক, কোনো কাজেই আমার উৎসাহের অভাব থাকতো না । বরং উৎসাহের প্রাধান্য থাকতো। এই চরিত্রটির ব্যাখ্যা  একমাত্র আমার পক্ষেই করা সম্ভব । আমি ছাড়া অন্য কেউ করতে চাইলে পদে পদে ঝুঁকি নিতে হবে ।
তিনসঙ্গী -র ক্ষেত্রে অন্য কিছু হয়নি। সব ব্যাপারে যেন আমাকেই  এই কাজটা করতে হবে, এই মনোভাব নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তাম। ঝাঁপানোর আগে জলের গভীরতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ভাবতাম না ।
সে বছরই বইমেলাতে স্টল হবে।আমি  আগ বাড়িয়ে বলে দিলাম আমরা নিজেরাই স্টল বানিয়ে  নেবো ।তার জন্য বাটাম কেনা, চট কেনা ---সব নিজে বানিয়ে ফেলেছিলাম । এক -দু ঘণ্টার জন্য  আমাদের পাড়ার কাঠগোলার সুদক্ষ কাঠমিস্ত্রি রমা দার সাহায্য নিয়েছিলাম। এর সবটাই কি শ্যামলদার প্রতি আনুগত্য থেকে করেছিলাম মনে করাটা ভুল হবে।আমি করেছিলাম আমার চরিত্র গুণে কিংবা দোষে।
মেলার কথা পরে বললেও চলবে।
এখন বরং তিনসঙ্গী -প্রাপ্ত  অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করি ।ভেবে দেখি কতটুকু মনে করতে পারি । সমীরের ব্রাঞ্চে কাজ করতো কোটোদা।কোটোদার সুপারিশ মতো তিনসঙ্গী তে চাকরি পেয়েছিল মেজদা।যে মেজদা নোট গুনতে গুনতে ঘুমিয়ে পড়তেন।
তবে তিনসঙ্গী থেকে  আমি পেয়েছিলাম বাংলাসাহিত্যের  অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী -কে।এই মহান লেখক ঠিক কী কারণে  আমাকে পছন্দ করতেন তা আমি বলতে পারবো না । যখন যা যেদিন আসতেন অনেকটা সময় আমার পাশে বসে কাটাতেন। তিনসঙ্গী থেকে তো তাঁর কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে বলে তো আমার মনে পড়ছে না ।তবু তিনি আসতেন,  এসে সিঁড়ি তে বসতেন, যে সিঁড়ি কে আমরা রকে রূপান্তরিত করে নিয়েছিলাম ।
এক কাপ চায়ের পরে কমপক্ষে তিনটি বিড়ি।এটাই  তাঁর ধূমপানের দস্তুর ছিল । জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী কি এমন কোনো কথা বলতেন যা লেখার জন্য  আবশ্যক ছিল ? না, তিনি এমন কোনো উপদেশ দেননি যা আমাকে উৎসাহিত করেছিল। তবে তিনি যেসব গল্প লিখে গেছেন সেগুলি একজন সাধারণ পাঠক পাঠ করার পর তাকে গল্প লেখার দিকে টেনে নিয়ে যায়।





৭২•দ্বিতীয় পর্ব

গতকাল জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী সম্পর্কে বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম ।আজ সেখান থেকেই শুরু করছি ।
জ্যোতি দা কীভাবে যেন বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন  আমি ওনার গল্পের গুণমুগ্ধ পাঠক ।হয়তবা ভক্তের সঙ্গে দ্যাখা করতে আসতেন উনি ।
বারো ঘর এক উঠোন যাঁরা পড়েননি, তাঁরা কীভাবে  রাস্তা পারাপার করেন, আমি জানি না । আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি  ওই উপন্যাসটি না পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় না । রাত্রে মশারিও টাঙানো যায় না ।
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী -র একটা নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে সেদিন  আনন্দ থেকে ।ওখান থেকে সোজা তিনসঙ্গী -র সিঁড়ি কাম রকে। একটা জীর্ণ কাঁধে ঝোলা ব্যাগ থেকে এক কপি নতুন বই আমাকে দিয়েছিলেন ।স্বাক্ষর করে ।
এই সূত্রে শ্যামলদার বই দেবার কথাটা বলে রাখি । সে সময়ে শ্যামলদার যে কটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, প্রতিটি বই-ই আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।যার বা সেগুলির পাতার ওপর স্পষ্ট করে লিখে দিয়েছিলেন ---
                      প্রভাতদা কে
                          শ্যামল
নীচে তারিখ বসাতে কখনোই ভুলে যাননি শ্যামলদা ।বাংলাভাষার আর কোনো অগ্রজ লেখক কোনো অনুজ কে এভাবে বই উপহার দিয়েছেন, তা আমার  জানা নেই, শোনাও নেই।
শ্যামলদাও অন্য কোনো    অনুজ কে এভাবে লিখে দিয়েছেন,  এমনটা আমার মনে পড়ছে না ।
সেই অর্থে  আমি ছিলাম শ্যামলদার প্রভাতদা।
শ্যামলদার  উপন্যাস লেখার  একটা ব্যবহারিক রীতি ছিল ।লাইনটানা বাঁধানো খাতায় লিখতেন । হাতের লেখা ছিল ছোটো ছোটো ।কিন্তু স্পষ্ট । পড়তে সমস্যা হবে এমন একটিও অক্ষর  লিখতেন না।
আরো একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, খাতার মলাটে প্রতিটি অধ্যায়ের নোট লিখে রাখতেন । সেরকম বাঁধানোখাতার মলাট আমাকে দিতেন।কেন দিতেন তা আমার জানা নেই ।হয়ত আমাকে অপেক্ষাকৃত বেশি  অনুগত মনে করতেন বলেই ।
আমি সেই বাঁধানো খাতার আলাদা করে রাখা মলাট গুলি সযত্নে রেখে দিয়েছি ।
যাঁরা  আমাকে আধুনিকতার বিরোধী বলে চিহ্নিত করেন , তাঁরা জানেন না,  আধুনিক কবিলেখকদের প্রতি শ্রদ্ধা র অবস্থান টিকে।আমরাই তো পরবর্তীতে  আধুনিক পর্বের অন্যতম প্রধান কবি আলোক সরকারের কাব্যসমগ্র প্রকাশ করেছিলাম চার খণ্ডে, কিন্তু গদ্যসমগ্রও করেছিলাম ।সেসব পরে লেখার সুযোগ পাবো ।বিশেষ করে আলোক-ভক্তদের অসহযোগিতার প্রসঙ্গে সবকিছু খোলাখুলি লিখবো।ভক্তবৃন্দের মুখোশ খুলে যাবে।

আবার ফিরে যাই তিনসঙ্গীতে।
তিনসঙ্গী হবার পর সমীর- এর সংক্রান্তি নাম পরিবর্তন করে হল---নতুন সময়কাল।
আমার সৌভাগ্য সমীরের পত্রিকার প্রায় প্রতিটি  সংখ্যাতেই আমার ছোটো গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে  একটাও গোলগল্প ছিল না, গালগল্প ও ছিল না ।
আমার  একটা ছোটোগল্পের বই হবার দরকার ছিল । নতুন প্রজন্ম পড়ার সুযোগ পেতো। বড়ো দেরি হয়ে গেল।
কৃষিকাজ থেকে পশুপালন নামে একটা গল্প লিখেছিলাম অমৃত-তে।ওটা খুঁজে পেলেই হয়ে যাবে।
অপেক্ষা করছি, কেউ নিশ্চয়ই দেবে।




৭৩•দ্বিতীয় পর্ব

ফেসবুকে  অধিকাংশ নবীন প্রজন্মের লেখক -কবি ।তাদের পক্ষে কৃষিকাজ থেকে পশুপালন গল্পটি উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই, এটা জোর দিয়ে লেখা যায়।
নতুন সময়কাল -এ প্রকাশিত দুটি গল্পের  উল্লেখ করছি, মূলত নিজেকে শোনানোর জন্য । একটি গল্পের নাম ---মনচোরা ডোম এবং একালীন বঙ্গসমাজ। অন্যটি --- একটি চিঠি এবং তার টীকা টিপ্পনী ।
মনচোরা ডোম একটি পুকুরের শ্যাওলা বা কচুরিপানা পরিষ্কার করতো। শৈশবে খিদের কারণে সে নাকি একটা  আস্ত ছাগল খেয়ে ফেলেছিল। সেই ঘটনার কীসব প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার বিবরণ ছিল ।খুঁটিনাটি ।
আর চিঠির গল্পটি কিছুটা কাল্পনিক । এক মহিলা  আত্মহত্যা করার আগে একটি চিঠি লিখে যান। এই গল্পটিতে নিয়ে  এসেছিলাম আসানসোলের এক কমরেড তথা গল্পকারের স্ত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা ।
এই গল্প দুটি রজতেন্দ্র রা পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। পরে আমরা রি-প্রিন্ট করেছিলাম বলে।
এখনকার পাঠক কীভাবে  এর সন্ধান পাবে।
আর অমৃত-তে প্রকাশিত গল্প কৃষিকাজ থেকে পশুপালন ।তার সন্ধান পেয়েছিলাম উলুবেড়িয়া থেকে ।মহম্মদ জিন্নুরের বাড়ি তখন প্রায়শই যেতাম । একজন ছাগল চড়ানোর কাজে লিপ্ত । আগে সে চাষাবাদ করতো।অর্থাৎ কৃষিকাজে নিযুক্ত ছিল ।সভ্যতার  ইতিহাস বলে যে মানুষ পশুপালন থেকে কৃষিকাজে উন্নীত হয়েছিল ।কিন্তু এই গল্পটির বৈশিষ্ট্য হল গল্পটির প্রধান চরিত্রটি ইতিহাসের চাকাকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

আত্মকথনে নিজের লেখালেখির কথা তো প্রাধান্য পাবে । এতে কার কী বলার থাকতে পারে ।বললেই বা কী ।আমার লেখার কথা লিখে যাবো।

তিনসঙ্গী-র পরে পরেই  আর একটি প্রকাশনা সংস্থার জন্ম হয়েছিল ।সপ্তর্ষি।মালিকের নামটা গত  দুদিন মনে আনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সব মনে পড়ছে, নামটা বাদ দিয়ে ।
ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল বিজয়গড়।দুর্গাপুজোর বদলে ভারতমাতার পুজো করতেন বেশ ধুমধাম করে।চাকরি করতেন একটা বড়ো করতেন কারখানার টেস্টারের চাকরি ।বেশ অভিনব । আর ব্যবসা ছিল কর্পোরেশন -এর টিউবওয়েল বসানোর। অবস্থা ভালো । সম্ভবত  অমিতাভ চৌধুরীর সূত্রে বই -ব্যবসাতে এসেছিলেন।শ্যামলদার সঙ্গে প্রেস ক্লাবের আড্ডা তেও কয়েকবার অংশগ্রহণ করেছেন।
সেই সপ্তর্ষি থেকে যে আমার সতীসাবিত্রী কথা প্রকাশিত হচ্ছে তা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি ।
একদিন শ্যামলদা  এক ব্যান্ডিল প্রুফ দিয়ে বললেন উৎসর্গপত্র টা লিখে দিন প্রভাতদা।
লিখে দিলাম ---'দিদিমা কে।
বিশ্বাস করুন,  আমি আদৌ জানতে পারিনি যে আমার সতীসাবিত্রী কথা প্রেসে গেছে, প্রুফ দেখা হয়ে গেছে ।শ্যামলদা  এর বিন্দুবিসর্গ জানতে দেননি ।
একই সঙ্গে মহত্ব  এবং রহস্য প্রকাশের দ্বিতীয় উদাহরণ কেউ দেখাতে পারবেন না ।
আমাকে যাঁরা হিংসে করেন তাঁরা জানেন না আমার মাথার ওপর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের  একটা শক্তপোক্ত হাত ছিল, যা এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে ।




৭৪•দ্বিতীয় পর্ব

সতীসাবিত্রী কথা প্রকাশিত হল শ্যামলদার বদান্যতায়। আমার  আহ্লাদের সীমাপরিসীমা রইল না । নিজেকে লেখক ভাবতে শুরু করে দিলাম । পরক্ষণেই মনে হল এসব চিন্তা মাথার মধ্যে স্থান দেওয়া ঠিক হবে না ।
বঙ্কিমচন্দ্র কত বছর আগে রেড়ির তেলের আলোয় বিষবৃক্ষ লিখেছিলেন । রবীন্দ্রনাথ চতুরঙ্গ লিখেছিলেন । তারাশঙ্কর লিখেছেন ধাত্রীদেবতা পঞ্চগ্রাম।বিভূতিভূষণ লিখেছেন ইছামতী ।জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী -র বারো ঘর এক উঠোন, সন্তোষকুমার ঘোষের শ্রীচরণেষু মাকে, বিমল করের দেওয়াল, প্রেমেন্দ্র মিত্র -র সূর্য কাঁদলে সোনা, ইত্যাদি  উপন্যাসের পাশে কখনোই সতীসাবিত্রী কথা রাখার কথা ভাবাও পাপ হবে ।
মনে রাখতে হবে তার বহু আগে প্রকাশিত হয়েছে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কুবেরের বিষয় আশয়, কমলকুমার মজুমদারের  অন্তর্জলি যাত্রা, মতি নন্দী, দেবেশ রায়,দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাসগুলি। সেই মহৎ লেখালেখির পাশে বসার কোনো অধিকার নেই সতীসাবিত্রী কথা -র। কাজেই আমার যতটুকু পাবার তার থেকে অনেক বেশি পেয়ে গেছি ।
আমার সমকালীন বহু লেখক আমার মতো সুযোগ পায়নি।এই প্রসঙ্গে  আমি মাত্র চণ্ডী মণ্ডলের নামটা উল্লেখ করছি । চণ্ডী মণ্ডল হাত নেই নামে একটি উপন্যাস লিখেছিল।প্রথমে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল কবিপত্র - এ। এই মানের উপন্যাস বাংলাভাষায় খুব বেশি লেখা হয়নি ।সে তুলনায় নিজের লেখাকে কিছুতেই স্থান দিতে পারবো না । নিজের জন্য  একশো জন ঢাকি-কে নিয়োগ করেও কোনো লাভ হবে না ।
তার থেকে বরং কম্পোট জোনে খেলা যাক । চলে আসি বইমেলার মাঠে ।তখন বইমেলা হত ভিক্টোরিয়ার  পাশের এক চিলতে জায়গায়। প্রথমে দক্ষিণ দিকের অংশে, পরে দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরকে যুক্ত করে।
সেই সময়ে  একবার তিনসঙ্গী  এবং সপ্তর্ষি একত্রে স্টল করেছিল। মেলার দ্বিতীয় দিনে স্টল খোলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দুজন খদ্দের  এসে হাজির ।দুজনেই যুবতি এবং সুন্দরী। সতীসাবিত্রী কথা কিনলেন।কী মনে করে কিনেছিলেন তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমি ভেবেছিলাম ভুল করে কিনে ফেলেছে । যেকোনো দিন হয়ত ফেরত দিতে  আসবে, এমনটাই আমার মনে হয়েছিল ।ক-দিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম ।কিন্তু অবাক কাণ্ড, সতীসাবিত্রী কথা ফেরত দিতে আসেনি ।
আরো একটি তথ্য দেওয়া যেতে পারে, সেবছর বর্ধমান বইমেলায় স্টল করেছিল সপ্তর্ষি । ২০ কপি নিয়ে গিয়েছিল সতীসাবিত্রী কথা ।শুনেছিলাম প্রথম দিনেই ২০ কপি সতীসাবিত্রী কথা বিক্রি হবে গিয়েছিল । ক্রেতারা কি ঠাকুরদেবতার বই মনে করে কিনেছিল?
আমার ধারণা ভ্রান্ত ছিল । আমি জেনেও জানতাম না যে লেখাটি  অমৃত -তে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল ।কাজেই বিক্রি হবার মধ্যে কোনো রহস্য নেই, স্বাভাবিক কারণেই বিক্রি হয়েছে।

সেই সময়ে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছিলাম হয়তোবা ।কিন্তু সেটাই ডেকে আনলো এক নতুন বিপদকে। পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ এগিয়ে যেতে শুরু করলেন।কিন্তু এতে আমার কী করণীয় তার আমি বুঝতেই পারলাম না ।
আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম । তখন এ ছাড়া আর কীই বা করতে পারতাম আমি ।




৭৫•দ্বিতীয় পর্ব

আরো একটি গোপন কথা ওপেন করছিলাম।কিন্তু ভেবে দেখলাম,  আর দু-তিন দিন পরেই না হয় গোপনকথায় আসবো।
এখন বইমেলার স্টল-ফেরত খবরাখবর দেওয়া যাক। আগেই বলেছি প্রথম বছর স্টল নিজেরাই বানিয়েছিলাম।দ্বিতীয় বছরও সম্ভবত।
স্টল খোলা এবং বন্ধের দায়িত্ব ছিল  আমার ওপর। বা আমাকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল । মেমোও  আমাকে করতে হত।তার মানে হল বিক্রির কাজে আমার ভূমিকা ছিল প্রধান ।
আগেই জানিয়েছি স্টল তৈরি করতাম।তাহলে আর বাকি থাকলো কী? বাকি থাকতো দেখনদারি। সেটাতে কারো দক্ষতা কম ছিল না ।
একদিন খবর পেলাম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন স্টলে আসবেন বই কিনতে।উত্তম-সুচিত্রা জুটির সুচিত্রা সেন ।সপ্তপদী, শাপমোচন, সবার ওপরে, সাগরিকা  সাড়ে চুয়াত্তর, ওরা থাকে ওভারে, হারানো সুর, শিল্পী, জীবনতৃষ্ণা, প্রমুখ আরো অসংখ্য সিনেমার নায়িকাকে আজ খুব কাছ থেকে দ্যাখার সুযোগ পাবো ---এটা  আমার ভাবনার মধ্যে ছিল না ।তিনসঙ্গী-র স্টলে বসার সুবাদে এই নতুন প্রাপ্তি ।তবে এর জন্য অমিতদা বা অমিতাভ চৌধুরী -র ভূমিকাই প্রধান । অমিতদা তাঁর বন্ধু রমা  অর্থাৎ সুচিত্রা সেন -কে আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন তিনসঙ্গী স্টলে আসার জন্য ।সুচিত্রা সেন সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন মাত্র ।
এর আগেও একবার সুচিত্রা সেনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। অভিনেতা নীতিশ মুখার্জি ছিলেন আমার প্রতিবেশী । ওনার দুই ছেলেই  আমার বিশেষ স্নেহভাজন ।সেকারণে নীতিশবাবু যেদিন মারা গেলেন, আরো অন্য বন্ধুদের সঙ্গে আমিও নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম ।সেখানে থেকে শ্মশান । নীতিশবাবুর দেহকে যখন স্পর্শ করে ফেলেছে আগুন,  আমরা ক-জন তখন শ্মশানের সামনে রাস্তার ওপর।হয়ত বাড়ি ফেরার পথে ।তখন একটা বড়ো মাপের কালো গাড়ি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। জানলার কাচ নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন নীতিশবাবুর কথা । আমি সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে ছিলাম।
বড়ো দেরি হয়ে গেল, বলে গাড়ির কাচ তুলে দিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন ।
সেই তিনি  আজ আমাদের স্টলে আসবেন ।
খবর পেলাম তিনি মেলার মাঠে ঢুকে পড়েছেন।
গিল্ডের এবং পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক ভাবে স্টলে  এসে জানিয়ে দিয়ে গেল , উনি এসে গেলে কী করতে হবে।
তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত টি এল।তার পাঁচ মিনিট আগে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনি  এসে পড়েছেন।তিনি এলেন, তাঁকে গোল হয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুলিশ ।স্টলে ঢুকে যাবার পর ওরাই বন্ধ করে দিল কল্যাপসিবেল গেট। বাইরে পুলিশ বেষ্টনী, আর অসংখ্য মানুষের ভিড়। এত ভিড় কল্পনা করা     যায় না।একবার মাত্র চোখের দ্যাখার জন্য এই অপেক্ষা ।
জনপ্রিয়তা  একেই বলে।
তিনি এর আগেই সিনেমার কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।  আত্মগোপনে ছিলেন।স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন ।তবুও তাঁর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমে যায়নি।
তিনি স্টলে  আসছেন বই কিনতে ।এমনটাই কথা  শুনেছিলাম । এবার তাঁর বইকেনার নমুনা পেলাম  । তিনি প্রতিটি তাকের সামনে দাঁড়াচ্ছেন আর বই নির্বাচন করে কাউন্টারে রাখছেন ।কেনার বইয়ের পরিমাণ ক্রমশ উঁচু হচ্ছে ।
আমি দ্রুত ক্যাশমেমো তে লিখতে শুরু করে দিয়েছি নাম এবং দাম।
সুচিত্রা সেন সেদিন ত্রিশটার বেশি বই কিনেছিলেন।
আমি সেদিন  একটা বোকামি করেছিলাম । ওনার জন্য কেনা কোল্ড ড্রিঙ্ক  অফার করেছিলাম ।
উনি  অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন ---আমি তো খাই না।




৭৬•দ্বিতীয় পর্ব

সুচিত্রা সেনের স্টলে  আসা এবং বইকেনার ঘটনাটা দ্রুত ছড়িয়ে গিয়েছিল সর্বত্র । রাতারাতি আমরা হিরো বনে গিয়েছিলাম ।
আর আমার মধ্যে সেই রেশ একদিনে মুছে যায়নি ।সপ্তাহ খানেক সময় নিয়েছিল।এই আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে  আমি যে সত্যকে গোপন করলাম না, এটা বোঝা গেলেই আমি দায়মুক্ত ।

আমার  একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল প্রতিদিনের ।কাজটা হল ক্যাশ মেলানো।স্টলের গেট বন্ধ করে হিসেব  শুরু হত। কত ক্যাশ নিয়ে শুরু করেছিলাম + সেদিনের মোট বিক্রি কত টাকা ,দুটোর যোগফল না মেলা পর্যন্ত চলতো হিসেব।কিন্নর রায় বেশ মজা  করে এই বৃত্তান্ত লিখেছিল আমাদের প্রভাত চৌধুরী গ্রন্থটিতে।বিশদে যাঁরা জানতে আগ্রহী, তাঁরা এই বইটির খোঁজ করতে পারেন ।
তবে  এই হিসেব-পর্বে সমীরের সক্রিয়তার কথা না বললে অন্যায় হবে।সমীর ব্যাঙ্ক -কর্মী, ওর পক্ষে এই কাজে দক্ষতা  অনেক বেশি ছিল ।
কবিতা পাক্ষিক পর্বে  এই কাজটা করি বাড়ি ফেরার পর ।
তখন  অমৃত-যুগান্তর বন্ধ হয়ে গেছে।তখন তিনসঙ্গী -ই একমাত্র আশ্রয়ের জায়গা,  আমার কাছে ।ঠিক এরকম সময়ে এক বিকেলে এক স্বল্প পরিচিত ভদ্রলোক এলেন তিনসঙ্গী-র রকে।অনেক বার্তা বিনিময় হল।মূলত ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ।আমার লেখার ভবিষ্যত নিয়ে ।কোথায় বা কোন পত্রিকায় লিখবো সেসব নিয়ে । শেষে জানালেন  এক সম্পাদক আমার কাছে দুটি গল্প চান। একটি ছাপা হবে অমুক সংখ্যাতে অন্যটি তমুক সংখ্যাতে ।ততক্ষণে আমার মতো স্বল্প -মেধার লেখকও বুঝে গেছি ধানাইপানাই -এর উদ্দেশ্য ।
আমি বোবা সেজে বলেছিলাম --- আপনি সম্পাদক মশাই -এর কাছে জেনে আসুন, বিশেষসংখ্যায় উপন্যাস কবে ছাপা হবে, আর প্রথম ধারাবাহিক  উপন্যাস কখন শুরু হবে ।যেদিন এর উত্তর নিয়ে আসবেন, তার সাতদিনের মধ্যে গল্প দিয়ে দেবো।ভদ্র মহোদয় সেই যে গেলেন, আর ফিরে এলেন না ।যতদিন তিনসঙ্গী ছিল সেই মহোদয়কে  আর দ্যাখা যায়নি ওই চত্বরে ।
আমার  অজানা ছিল না কীভাবে পাতাভরানোর লেখা ছাপতে হয়। কোনো কোনো লেখককে টার্গেট করে মহান বানানো হয়।তাঁদের উপন্যাস, ধারাবাহিক  উপন্যাস ইত্যাদি ছাপা হয়।বাকিরা কেবলমাত্র গল্পকার হিসেবে থেকে যান।তিন বছরে দশটি গল্প ছাপা হলেওকখনো উপন্যাস লেখার সুযোগ পাননি।আমি কমপক্ষে কুড়ি জনের নাম গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারি।
আমি  অমৃত -তে শারদ সংখ্যাতে উপন্যাস লিখেছি, ছোটো ধারাবাহিক লিখেছি।আমি  ফালতু লেখক নই । আমি নির্বোধ হতে পারি, অক্ষম হতে পারি, কিন্তু আমার মেরুদণ্ড সোজা।আত্মমর্যাদা এবং আত্মবিশ্বাস প্রবল।তখনো ছিল,  এখনো আছে ।আমি আমার অহংকার নিয়েই হেঁটে যেতে চাই।
আমাকে আক্রমণ করে যাঁরা তীব্র  আনন্দ পান, তাঁরা জানেন না, ওইসব আক্রমণ আমাকে আরো বেশি  অহংকারী করে তোলে।




৭৭•দ্বিতীয় পর্ব

অহংকার এমন একটি শব্দ, যার ব্যাখ্যা ঠিক মতো করা সম্ভব নয়।যাকে ঠিক মতো দ্যাখাও যায় না।যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, যাকে স্পষ্ট করে দ্যাখা  যায় না, তা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন। বরং ঘটনার ঘনঘটায় ফেরা যাক ।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলে রাখি,  এটা কোনো রহস্য কাহিনি নয় ।যারা মধ্যে প্রতিপদে রোমাঞ্চকর ঘটনাবলি থাকবে । এটি আমার  আত্মজীবনীর অংশ মাত্র । এই অংশটুকু তে কেবলমাত্র আমার লেখালেখির কথাবার্তা লিখবো তেমনটাই থাকার কথা ।সেভাবেই লিখে চলেছি ।আমার বিশ্বাস  একটা বিশেষবয়সে পৌঁছে সকলেরই এরকম একটা লেখার কথা ভাবা এবং লেখা ।এতে এমন অনেক ব্যক্তিগত কথা লেখা যাবে, যা আগে কখনোই লেখা হয়নি । এই লেখাতে নিজেকে অনেকটাই  উন্মোচন করা সম্ভব হবে ।

একবার  অমৃত-র লেখার সূত্রে বিশিষ্ট অভিনেতা  এবং নাট্য পরিচালক শ্যামল ঘোষের বাড়ি গিয়েছিলাম।শ্যামলদা তখন যাত্রাশিল্প প্রবেশ করেছেন। ওথেলো পালা-য় ওথেলোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। পালাটা বেশ জমে গিয়েছিল।বা প্রতিদিন প্যান্ডেল-ফুল দর্শক । আমি শ্যামলদার নক্ষত্র গ্রুপের সব নাটকের দর্শক হিসেবে  উপস্থিত থেকেছি।আমার জানা আবশ্যক ছিল, নাটকের দর্শক সংখ্যা মেরেকেটে চার-পাঁচ শো, কিন্তু যাত্রার সময়ে তা হয়ে যায় দু-হাজার।এতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা।
শ্যামলদার সবিনয় উত্তর ছিল ,আমি অভিনেতা,অভিনয় করা আমার কাজ।
অনেক পরে,এইতো সেদিন বাগবাজার সুতানুটি বইমেলাতে শ্যামল ঘোষকে পেয়েছিলাম ঘনিষ্ঠ ভাবে ।শ্যামলদার স্ত্রী আমাদের মুরারির গ্রামের মানুষ ।মুরারির খুবই আত্মজন।মুরারির ডাকনাম যে অষ্ট সেটা ওদের কাছে ই জেনেছিলাম ।





৭৮•দ্বিতীয় পর্ব

অহংকারকে তুলে রাখলাম ঢেঁকিশালায়। আমি জানি না অহংকার এবং অলংকার -কে যাঁরা  এক আসনে বসাবার কৌশল জানেন, আমার গোত্র তাঁদের সঙ্গে মেলে না । আমি আমার পথে চলতে থাকি।যে পথ সুন্দরের দিকে গেছে সেই পথ থেকে সরে আসা উচিত হবে না ।
অমৃত, তিনসঙ্গী কে কেন্দ্র করে যে পরিমণ্ডল তা থেকে আমি পুস্তক -ব্যবসা সম্পর্কে যেমন অভিজ্ঞতা  অর্জন করেছি তেমনি শ্যামলদার নির্দেশ মতো নিয়মিত পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশনা বিষয়ে কিছু কিছু শিক্ষণীয় পাঠ সমাধা করেছিলাম । আর সংগঠন করার যাবতীয়কে আমি জেনেছিলাম কমিউনিস্ট পার্টির ডাইরেক্ট কাজকর্মের মাধ্যমে । একটা সময়ে  আমি প্রতি শনি এবং রবি বার আমি জেলা-মহকুমা শহরে ছুটে গেছি কবিতার সংগঠন করতে। কবিদের সংগঠন করতে নয়।
সেই দিনগুলিতে চলে এসেছি প্রায়।  

এখন আবার ফিরে যাই  অমৃত - তিনসঙ্গী পর্বে।
যুগান্তর দিয়ে শুরু করা যাক। যুগান্তর -এর সাহিত্য  বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন প্রফুল্লদা বা প্রফুল্ল রায়। আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। প্রফুল্লদা ছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। অথচ আমার মতো অনামী -কেও লিখতে আহ্বান করতেন।রবিবারের পাতায় গল্প লিখিয়ে নিয়েছিলেন, বেশ কয়েকবার । একটা গল্পের কথা মনে পড়ছে।গল্পটির নাম ---হলুদ পাখির দুঃখ।কিশোর -কিশোরীর পাতি প্রেমকাহিনি। এমনকি বিখ্যাত লেখকদের দিয়ে একটা এক কলামের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল যুগান্তর -এর রবিবারের পাতায়। কলামটির নাম ছিল ---- আমার প্রিয়। আমাকেও সেই লেখা লিখতে হয়েছিল প্রফুল্লদার বদান্যতায়। আমি সেই  লেখাতে লিখেছিলাম শৈশবকথা। বাবা-মায়ের সঙ্গে ছুটির সময়ে দেশের বাড়ি যাওয়ার কথা ।ওই লেখাটা প্রকাশিত হবার পর জানতে পেরেছিলাম যুগান্তর -এ অনেক বাঁকুড়া -বাসী চাকরি করতেন। এতদিন আমার ধারণা ছিল, আমি একাই বাঁকুড়ার ।সেদিন আমার খুবই আনন্দ হয়েছিল । এর আগে নিজেকে বাঁকুড়ার লোক বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করতাম ।
প্রফুল্লদার সৌজন্যে শুরু করতে হয়েছিল ছোটোদের জন্য গল্প লেখা।ঘনাদা-টেনিদার ঘরানার একটা গুলগল্পের  একটা চরিত্রও তৈরি করেছিলাম।যদিও কোনো মহৎ গল্প লিখতে সক্ষম হননি, কিন্তু পাঠকদের জন্য পাঠ্য গল্প লিখতে পেরেছিলাম ।না হলে যুগান্তর বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রফুল্লদা যখন প্রতিদিন পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের দায়িত্ব নিলেন,  আমাকে দিয়ে রবিবারের গল্প এবং ছোটোদের গল্প লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন । আমি আমার সাধ্য মতো লিখেছিলাম ।

আমার দুর্ভাগ্য সেসব লেখালেখির কোনো কপি  আমি রাখিনি ।কেন রাখিনি, তার নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল।কারণটা হল--- আমি  ওইসব সাময়িক পত্রিকার লেখাকে সামরিক লেখা মনে করতাম।যেসব লেখা সাময়িক তার কোনো স্থায়ী জায়গা হতে পারে না । এখনো কেউ লিখতে বললে যেকোনো দিন  এক-সিটিংএ এরকম গল্প লিখে দিতে পারি ।
আমি  সাহিত্যের ইতিহাস জানি।রবীন্দ্রনাথের সময়ে শ্রীশ মজুমদারের নাম বা লেখা ইতিহাস মনে  রাখেনি।ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের নাম ক-জন মনে রেখেছেন।ঠিক সেই ফর্মুলা তে গতকাল ও যিনি জনপ্রিয় ছিলেন,  আজও যিনি জনপ্রিয় আছেন, তাঁরাও আগামীকাল হারিয়ে যাবেন। কবিতার ক্ষেত্রেও এরকমটাই হবে। চিত্তরঞ্জন দাশেরা মুছে যাবেন।Late wait and see.





৭৯•দ্বিতীয় পর্ব

যুগান্তর -এ প্রফুল্লদা ছাড়া ছিলেন  অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় বরেন গঙ্গোপাধ্যায় গৌরাঙ্গ ভৌমিক প্রমুখ লেখক এবং কবিরা ।
মনে রাখতে হবে  অতীনদা অনেক আগেই লিখে ফেলেছেন নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে -এর মতো মহান  কালজয়ী উপন্যাসটি ।শুরু করেছেন অলৌকিক জলযান ।
অতীনদার  একটা কথা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল ।বলেছিলেন, কেউ লিখতে বলুক কিংবা না বলুক, প্রতিদিন নিয়ম করে লিখতে হবে। লেখাটা ছেড়ে দেওয়া চলবে না ।কেননা লেখাটাই তোমার  একমাত্র কাজ ।কে কবে লিখতে বলবে, তারপর তুমি লেখা শুরু করবে---এভাবে হবে না ।তোমাকে লিখতে হবে নিজের জন্য ।
অতীনদা ঠিক কথাই বলেছিলেন। লেখা তো মূলত নিজের জন্যই।যতক্ষণ তিনি লিখছেন ততক্ষণ লেখাটা ভার্জিন।প্রকাশের পর লেখাটার ওপর পাঠকের  অধিকার জ্ন্মায়।তার আগে নয়। এই মনোভাব না থাকলে বড়ো লেখা সম্ভব নয়।
আমি মনে প্রাণে  অতীনদা কে বড়ো লেখকের মর্যাদা দিয়ে থাকি।
অতীনদা কে নিয়ে  কখনো খুব বেশি হইচই হয়নি।কারণ তিনি কখনো বাজারি-লেখা লিখতে পারেননি ।লিখেছেন  আপন খেয়ালে, আপন মর্জিতে।নিজেকেই ঋদ্ধ করতে চেয়েছেন।পাঠকের মন ভোলাতে নয়।
অতীনদা জাহাজে চাকরি করেছেন ।কঠিন পরিশ্রমের চাকরি ।জীবনকে দেখেছেন ভিন্ন অ্যাঙ্গেলে।ভিন্ন চোখে ।ভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়করেছেন ।না হলে এই মাপের লেখা সম্ভব হতো না।
এত রকমের মানুষ দেখেছেন,  এত রকমের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন ,  তা সত্ত্বেও অতীনদা খুবই ইন্ট্রোভাট।নিজের মধ্যে নিজেকে আড়াল করার কৌশল জানেন ।
একটা ছোটো পত্রিকায় অতীনদা  একটা গল্প লিখেছিলেন, সাদা অ্যাম্বুলেন্স।কোন যৌবনে পড়েছিলাম,  এখনো ভুলে যাইনি ।

অতীনদা ছাড়াও বরেণ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন আর একজন বিশিষ্ট কথাকার।বরেনদা ছিলেন এমন একজন লেখক যিনি বনবিবির উপাখ্যান নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন , যা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ ।সুন্দরবনের জীবন এবং জীবিকার ওপর এর থেকে ভালো লেখা আমার চোখে পড়েনি ।বরেনদা ছিলেন ভদ্রলোক টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি।নিপাট ভালো মানুষ ।
হিমালয়-ট্রেকিং এর ওপর একটা লেখা, কিছুতেই নামটা মনেকরতে পারছি না, ওটাও খুবই মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় লেখা ।

গৌরাঙ্গ ভৌমিক , কবি, ছিলেন স্কুলশিক্ষক।তো একদিন জয়েন করলেন যুগান্তর -এ। আমার থেকে বেশ কিছুটা বড়ো ছিলেন বয়সে।তবু বন্ধুত্বে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।বন্ধুত্ব  এতটাই গভীর ছিল, যে একবার দলবদ্ধভাবে পাণ্ডুক গিয়েছিলাম ।পবিত্রদাও ছিলেন সেই দলে।শচীন - অমরও গিয়ে ছিল সম্ভবত।
গৌরাঙ্গ ভৌমিক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অনুভব।খুবই সুসম্পাদিত পত্রিকা ।
স্কুলেও সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন । আমি  এখনো বুঝতে পারিনি তিনি কেন যুগান্তর -এ এসেছিলেন ।





৮০•দ্বিতীয় পর্ব

যুগান্তর -অমৃত-র শিল্পীদের কথা কিছুই বলা হয়নি । একমাত্র সুবোধ দাশগুপ্ত -র কথা লিখেছিলাম ।আরো একজনের কথা বিশেষ ভাবে বলতেই হবে।তিনি ধ্রুব রায়। ধ্রুবদা -ই একমাত্র শিল্পী, যিনি ক্রিকেট খেলতেন ।ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের নিয়মিত ক্রিকেটার ছিলেন । ধ্রুব দার  ইলাসস্ট্রেশন এবং কাজ বেশ প্রশংসিত হত।
শ্যামলদার দৌলতে আমরা দুজন নবীন শিল্পীকে পেয়েছিলাম  আমাদের টিমে।একজন প্রবীর সেন অন্যজন সুব্রত চৌধুরী ।প্রবীর এবং সুব্রত -র তখন হাতেখড়ি পর্ব।দুজনেই খুবই প্রতিভা সম্পন্ন । এর মধ্যে প্রবীরের আবার লেখার ব্যামো ছিল ।তখন ছোটোদের জন্য বেশ কিছু লেখা লিখেছিল। ওদের কাজ সর্বত্রই  গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল ।
আমার প্রথম প্রকাশিত  উপন্যাস সতীসাবিত্রী কথা -র প্রচ্ছদ করেছিল প্রবীর সেন।শ্যামলদার নির্দেশ মতোই তা হয়েছিল । অসাধারণ প্রচ্ছদ।প্রচ্ছদের কারণেই বইটির বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল এমনটা বলা খুব একটা ভুল হবে না ।
দ্বিতীয় বই দুঃখের পায়রা প্রকাশিত হয়েছিল তিনসঙ্গী থেকে ।তার প্রচ্ছদ করেছিল সুব্রত চৌধুরী । অদ্ভুত মায়াময় সেই প্রচ্ছদ এখনো আমি স্পষ্ট দেখতে পাই ।
অমৃত বন্ধ হবার পর প্রবীর এবং সুব্রত দুজনেই মর্যাদার সঙ্গে বিগ হাউজে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।কারো সুপারিশের প্রয়োজন হয়নি।নিজেদের যোগ্যতার জন্য হয়েছিল ।
আর একজন শিল্পী ছিলেন নিতাই ঘোষ।তিনিও যথেষ্ট গুণী শিল্পী ছিলেন ।
আজ ও কিস্তি ছোটো হল।





৮১•দ্বিতীয় পর্ব

কীভাবে যে তিনসঙ্গী -র মতো অগ্রসরমান একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল, মনে করতে পারছি না ।তবে ব্ন্ধ হওয়া টা বাস্তব ছিল । আমার বিশ্বাস ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনসঙ্গী তৈরি করা হয়েছিল, সেই  উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল । একারণে তিনসঙ্গী -কে সজীব রাখাটা জরুরি ছিল না ।
তিনসঙ্গী তার গুরু দায়িত্ব পালন করেছিল,  অক্ষরে অক্ষরে ।একটা অক্ষরও এদিক ওদিক হয়নি। ত , ন, স, ঙ  এবং গ, এই অক্ষর বা বর্ণগুলি নিজের নিজের অবস্থানে সুদৃঢ় ভাবে উপস্থিত ছিল ।তবুও তিনসঙ্গী -কে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি।আমি  এর বেশি বলার অধিকারী নই। তিনসঙ্গীতে আমি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রক্সি দিতাম মাত্র ।
আমার প্রক্সি দেবার কাজ খতম হবার  পর কিন্তু কাজের অভাব হয়নি। কীকরে যেন জনে জনে সেই  বার্তা রটে গিয়েছিল যে একজন গতরে খাটার লোক পাওয়া গিয়েছে ।Use and through.

তারা জানতো না আমিও কিছুটা শিখে ফেলেছি ইতিমধ্যে ।গায়ে-গতরে খাটার মোহ  আর অবশিষ্ট নেই আমার জীবন-শৈলীতে।আমিও কিছুটা চালাকচতুর হয়ে উঠেছিলাম ।অতএব  আহ্বান এবং আমন্ত্রণ গুলোকে খুব বেশি পাত্তা দিইনি । বন্ধুজনেরা নিরাশ হয়েছিল।কিন্তু বিশ্বাস করুন,  আমি তখন যা করেছিলাম, তাতে কোনো ভুল ছিল না । আমি নিজের দিকে তাকাতে শুরু করেছিলাম । নিজেকে দ্যাখাতে শুরু করেছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না ।
তবে আমার যাবার জায়গা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল ।এমন অবস্থা হয়েছিল যে যাবার মতো একটা জায়গাও  অবশিষ্ট ছিল না ।কিছুদিন খালি তাসের দেশে ছিলাম ।ব্রিজের টিম বানিয়েছিলাম ।আমার মেজভাই দীপক তখন বোকারো থেকে কলকাতায় চলে এসেছিল।মূলত ওরই  উদ্যোগ এবং উৎসাহে তাস-পর্ব।
চাকরি করতাম হেলথে।রাইটার্সে ।বন্ধুদের মধ্যে রুহিদাস  এবং বিমানের প্ররোচনায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের যুক্ত কমিটির কাজকর্মে ফেঁসে গেলাম। রুহিদাসদের সঙ্গেই ছিলাম । পুরোনো একটা কমিউনিস্ট ব্যাকগ্রাউন্ভ ছিল ।কোচবিহারের রাজ্য সম্মেলন থেকে ঘোষিত হল--- আমি রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ।যে কোনোদিন ব্রাঞ্চ কমিটির মেম্বারও ছিলাম না,  একারণেই লাফে রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলী তে উড়ে এসে জুড়ে বসে গেলাম । এটা পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল । আমি হলাম সমিতির মুখপত্র বা পত্রিকার সম্পাদক ।
মূলত রুহিদাসের জন্য  এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলাম ।না নিলে অন্যায় হত।রুহিদাস  আমার জন্য যা করেছে, এমনকি এখনো করে তার এক পার্সেন্টও আমি  ওর জন্য করিনি ।

কবিতার কথা থেকে সরে গিয়েছিলাম বলে যাঁদের মনে হচ্ছে, তাঁরা শুনে রাখুন,  আমার কবিতার সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থকের নাম রুহিদাস সাহারায়। আগেও ছিল, এখনো আছে ।
যখন খোকার মা  আঁচল বাঁধ/ একটা কিছু করতে হবে থেকে শুরু করে আজকের লেখা ---
  শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎকার
পর্যায়ে সেই সমর্থন বজায় আছে । একজন কবিতালেখকের কাছে এই সমর্থন কতটা জরুরি তা আমার থেকে কেউ বেশি জানে না

কবি-সঙ্গ পরিত্যাগ করলেও বইমেলা- সঙ্গ পরিত্যাগ করতে পারিনি।বইমেলা শুরুর দিন থেকে  শেষদিন পর্যন্ত মেলা আমাকে ডেকে নিত।
শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক অফিস সূত্রে ।তখন মূলত শান্তিময়ের সঙ্গেই বইমেলায় যেতাম । অতি অবশ্যই বারদুয়ারি ফেরত ।
মেলায় যারা স্টল বানাতো তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার পরিচিত ছিল।তাদের মালপত্র রাখার গলতা থাকতো।গলতার  অর্থ হল দুটো স্টলের মধ্যের কিছুটা জায়গা, বাইরে থেকে দৃশ্যমান নয়। ওই গলতাই ছিল আমার নিজস্ব ঠেক। ওখানেই পেয়েছিলাম চাঁদু-কে।লিটল ম্যাগাজিনের পরশপাথর ।যাকে ছুঁলেই সোনা।শান্তিময়ের হাত ধরে ঢুকে পড়েছিল  আমার গলতায়। আমি সর্বশক্তি দিয়ে ধরে ফেলেছিলাম চাঁদুকে।
চাঁদু-কে অনেকেই শুভ চট্টোপাধ্যায় নামে চেনে ।শান্তিময়-শুভরা বহরমপুর থেকে একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করতো---রৌরব।
কমল চক্রবর্তী রা করতো----কৌরব।
কৌরব অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত ছিল ।কিন্তু রৌরব ছিল তান্ত্রিক -সাধনার পীঠ।কবিতার তন্ত্র সাধনা।এর ধর্মের তন্ত্র নয়।কবিতাও যে ধর্ম হতে পারে  এটা চাঁদুরাই দেখিয়ে দিয়েছিল।
আগামীকাল ও চাঁদুরাই চলবে।



৮২•দ্বিতীয় পর্ব

চাঁদু বা শুভ-র, সঙ্গে শান্তিময়ের, জলযাত্রার সঙ্গী হবার সৌভাগ্য  আমার হয়েছিল । এই স্মৃতি এখনো আমাকে উজ্জীবিত করে । আমি সব সময়ই সচেতন থাকার চেষ্টা করি যাতে ওদের  অসম্মান না হয়। আমি যদি কোনো লেখা ঠিক মতো লিখতে না পারি তাহলে চাঁদু-কে ছোটো করা হবে। চাঁদু ভাববে ওর জলযাত্রার সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হয়েছিল ।এই বোধই আমার লেখাকে দিকনির্দেশ করে।
চাঁদু দের সঙ্গে  আমার মদ্যপানের ব্যাপারটাকে আমি হাইলাইট করতে চাইছি বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা ভুল ভাবছেন  আমাকে।আমি চাঁদুর মধ্যে যে সম্পাদনা -স্পর্ধা দেখেছি তা শুনলে আপনারা স্তম্ভিত হবেন ।
অধিকাংশ লিটল।ম্যাগাজিনের সম্পাদক যখন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটি তে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, তিনি কত বড়ো মাপের কবি ।এজন্য ভাড়া- করা প্রাবিন্ধিককে ধরেকরে তাঁর কবিতার বই -এর সমালোচনা করান। আত্মপ্রচারের মহান যে কাজটি  যে লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান কাজ, এই বিশ্বাস কে ভেঙে দিয়েছিল চাঁদুরা ওদের পত্রিকা রৌরব-এর সুবিশাল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ।
কৌরব প্রকাশ করেছিল আলবেনিয়া-র ওপর বিশেষ সংখ্যা ।একটি নয় , দুটি।
দু-দুটো সংখ্যা, তাও আবার  আলবেনিয়া নামক দেশটির গণ-চেতনা,গণজাগরণের  ওপর। আমরা অনেকেই যখন নিজেদের কবিতা কিংবা কবিতা - আন্দোলন নিয়ে খুবই সিরিয়াস, তখন বহরমপুরের  একদল তরুণ তাদের সমগ্র কর্মকাণ্ড কে নিয়োজিত করেছিল আলবেনিয়া -র ওপর।নিজেদের কবিতা -গল্প -প্রবন্ধ কে কিছুটা বঞ্চিত করে তুলে এনেছিল আলবেনিয়া -কে।
আমি তো ভাবতেই পারি না ।
এদের কীভাবে শ্রদ্ধা জানালে আমি গ্লানি মুক্ত হবো ভেবে পাই না । আমিও তো দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পাশে থাকার কথা চিন্তা ভাবনা করতাম ।কিন্তু আমি তো পারিনি ।চাঁদুরা পেরেছিল। এদের কোন ভাষায়, কীভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হবে, তা আমার জানা নেই । আমি কি  ওদের লাল সেলাম জানাবো? আমার কি সেই অধিকার আছে ? জানি না ।
রৌরব সম্ভবত  এর পরেই বের করেছিল স্টালিন সংখ্যা ।সেটাও খুব মহৎ প্রচেষ্টা ।আমি  এমনটাই বিশ্বাস করি ।
কেউ বলতেই পারেন  এসবের সঙ্গে কবিতা  এবং সাহিত্য -র কী সম্পর্ক । আমি তাঁদের সঙ্গে তর্ক করতে যাবো না । আমি আমার বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই ।এই প্রসঙ্গে  এর বেশি একটিও বাক্য ব্যয় করছি না ।যাঁর যা ভাবার ভেবে নিতে পারেন । আমি সুন্দরের দিকে হাঁটতে গিয়ে এই পর্ব লেখার সুযোগ পেলাম, এতেই আমি ধন্য ।

আমাদের ওই সময়ে  এক্ষণ পত্রিকা বেশ কিছু মূল্যবান সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। ওরাও অনেক প্রণম্য কাজ করেছিলেন ।ওদের ধন্যবাদ জানাবার লোকের অভাব হয়নি ।কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, রৌরব-কে কজন সাধুবাদ জানিয়ে ছিলেন ।
আর যদি সঙ্গতির প্রশ্ন তুলি, তখন কী উত্তর পাবো জানি না ।হয়ত কোনো  উত্তর পাবো না ।
পরবর্তীতে দেখেছি ৮-১০ লক্ষ টাকার বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে বিশাল বিশাল বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন ।সেগুলিকে আমি যদি কেবলমাত্র  অর্থ সংগ্রহের চাবিকাঠি বলি, সেটা কি খুব ভুল বলা হবে।এদের আমি বাণিজ্যিক পত্রিকা বলে গণ্য করি।আমার ভাবনা ভুলও হতে পারে ।

আগামীকাল পার্থসারথি চৌধুরীর সঙ্গে বইমেলা ভ্রমণের কাহিনি । প্রিয় বন্ধুরা  অপেক্ষা করুন।




৮৩•দ্বিতীয় পর্ব

পার্থসারথি চৌধুরী -র মতো বড়োমনের মানুষ  আমি খুব বেশি দেখিনি । ওনার বই -এর সংগ্রহ যেকোনো লাইব্রেরি -কে টেক্কা দিতে পারে । কবিতা লিখতেন নিখুঁত ছন্দে, শব্দ ব্যবহার করতেন নিপুণ ভাবে ।
চাকরি সূত্রে পার্থদা ছিলেন I A S. অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্যায়ের আমলা।এহেন পার্থদা আমার মতো কেরানিকে কেন যে আমল দিতেন, তা আমার এখনো জানা হয়নি ।
পার্থদার পারিবারিক পরিচয়টা জানাতে আমি বাধ্য । পার্থদা ছিলেন সিনিয়র পি সি সরকারের জামাই।গীতাদির স্বামী ।এখনকার পি সি সরকারের জামাইবাবু ।
তাহলে বুঝতে পারছেন কবিতা লেখার সুবাদে  আমি কতকিছু যে অর্জন করেছি তার সীমাপরিসীমা নেই ।
আমার বিশেষ বন্ধু যোগব্রত চক্রবর্তী যেদিন মৃত্যু -কে ডেকে এনেছিল,  ওর বডি শোয়ানো ছিল মর্গে, কাটাপুকুরে।সেদিন পার্থদা আমাদের ক-জন নিয়ে গিয়েছিলেন মর্গে।আমরা শ্মশান পর্যন্ত এক সঙ্গে ছিলাম । আমার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে যে স্মরণসভা হয়েছিল তাতেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল পার্থদার ।
তার অনেক পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরেও  এমনটাই হয়েছিল ।পার্থদার সঙ্গেই হাওড়া স্টেশনে বডি নিতে গিয়েছিলাম ।
কেবলমাত্র ঘনিষ্ঠতা বোঝানোর জন্য  এই উদাহরণ দুটি টেনে আনলাম ।
অতএব  এহেন পার্থদা  আমাকে বাদ দিয়ে বইমেলাতে যাবেন কীভাবে ।
আমাকে সঙ্গে যেতেই হত। আমি বাধ্য সঙ্গে যেতে।সঙ্গ দিতে ।
পার্থদার টার্গেট ছিল বইবাজার।তখন মেলার শেষ তিন দিন   বইমেলার মধ্যে বইবাজার হত। ওখানে জলের দামে বহু মূল্যবান বই পাওয়া যেত।কেনার ইচ্ছে থাকলে ব্যাগ নয়, বস্তা নিয়ে যেতে হত।
ওখানে ওই বইবাজার থেকে কয়েক বস্তা বই কিনতেন তিনি ।সঙ্গদোষে আমাকেও বই কিনতে হত। আমি কী কিনবো, তাও নির্বাচন করে দিতেন তিনি ।
আমার বিদ্যা যে ফার্স্ট বুকের খোঁড়া লোক এবং ঘোড়ার দ্যাখা হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল পার্থদার তা জানার কথা নয়
. , জানতেন না সম্ভবত
আমিও কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেতাম না ।বাধ্য ছাত্রদের মতো তা পালন করতাম ।
একটা স্বীকারোক্তি করা উচিত, পার্থদাই শিখিয়ে ছিলেন কী বই পড়তে হবে, কীভাবে পড়তে হবে।
আমার  একটা অসুবিধা হত, বইমেলাতে  এসেছি, অথচ সন্তরণে নেই।সঙ্গী রা দেখে যাচ্ছে, কিন্তু  পার্থদার থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না ।
আমার যতটুকু পাণ্ডিত্য  ( আদৌ যদি থাকে ) তার প্রায় পুরোটাই পার্থদার সঙ্গলাভের জন্য ।
পার্থদার পরিচিত সকলেই  অবগত আছেন যে বই গুলি তিনি কিনতেন সবগুলোই পরিকল্পনা করে নতুন করে বাঁধাতেন।নিজস্ব বাঁধাই রীতিতে।বেশ কঠিন কাজ, পরিশ্রমের কাজ, দীর্ঘ সময়ের কাজ। এই কাজের পরিচয়ই প্রমাণ করে দেয় বইয়ের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের ব্যাপারটা ।
অনেকেই বই কেনেন, কিন্তু পার্থদার মতো বই-এর প্রতি ভালোবাসা ক-জনের  আছে তার হিসেব আমার কাছে নেই ।
আর একটা বই মেলার অপূর্ণতা কে পূর্ণ করেছিলেন বা পুষিয়ে দিয়ে ছিলেন বহু  পরে,নিজ নিকেতনে ।সেসব কথা বড়োগলায় বলতে নেই । না বললেও যাঁরা বোঝার ঠিক বুঝে যাবেন ।




৮৪•দ্বিতীয় পর্ব

জামালের প্রতিক্রিয়া মনে  আছে ।তবে সেটা যে মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগের কথা ।
পার্থদার হিতাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা কম ছিল না, তাঁরা মাঝে মাঝেই উপহার পাঠাতেন এমন একটি বস্তু, যা একাএকা উপভোগ করা যায় না ।সেরকম উপহার পেলে পার্থদা ফোনে নির্দেশ দিতেন---চলে এসো, একজন ফরাসি  অতিথি এসেছেন । আমি তখন থেকেই ডিকোর্ড করতে শিখে গেছি ।ফরাসি অতিথির প্রকৃত অর্থ হল ফরাসি দেশের পানীয়। আসলে পার্থদা অনুভব করতেন আমার ভাগ্যে বিদেশি খুব একটা জোটে না । আমার দৌড় দেশি স্কটিশ চার্চ পর্যন্ত ।
এভাবেই  একদিন পার্থদার ফোনের উত্তরে জামালের বাইকের পেছনে বসে পৌঁছে গিয়েছিলাম  সেই সন্ধেটিতে।জামাল যার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে । এটা আমার বলার কথা ছিল না । জামাল-কে সমর্থন করে ঘটনাটি উল্লেখ করলাম মাত্র ।

বলার কথা হল , সেবছর পুজো ক-দিন কোথাও যাবার নেই ।বাসুদেবপুর কিংবা কাদাকুলি যেতে চাইছিলাম না হয়ত।
পার্থদা তখন P. W. D -র প্রিন্সিপল সেক্রেটারি । চলে গেলাম তাঁর চেম্বারে ।সমস্যার কথাটা জানাতে।পরামর্শ নিতে ।
ভাবনার সময়ে পার্থদা তাঁর মুখের হাসিটা বজায় রাখতেন অদ্ভুত দক্ষতা য়।
সেরকম হাসিমুখে জানতে চাইলেন ---- ঝাড়গ্রামে যাবে?  ওখানে আমার একটা বাড়ি আছে।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো অসংখ্য প্রাচীন শালগাছ । চলমান ট্রেন থেকে দেখেছি ।কোনোদিনই ছুঁয়ে দ্যাখা হয়নি । এত বড়ো মাপের শালগাছ পশ্চিমবঙ্গ থেকে উধাও হয়ে গেছে ।একমাত্র ঝাড়গ্রামে টিকে আছে ।
শালগাছ প্রসঙ্গে  একটা অতীতকথা শুনিয়ে রাখি । আমাদের পারিবারিক জঙ্গলমহল ছিল বাঁকুড়ার দেশের বাড়ির গ্রামের কাছাকাছি  অঞ্চলে । দেশ স্বাধীন হবার পর দুই বরেণ্য দেশনেতা নেহেরু এবং প্যাটেল মধ্যস্বত্বভোগী দের সবকিছু কেড়ে নিয়ে ছিলেন ।সেকারণে  আমি ওই দুই দেশনেতা -কে বরেণ্য বলি না । অনেকেই জানেন কী বা কার নন্দন বলি।লেখার সাহস নেই।
আমি যে পটলভাঙার বাড়িতে পিলখানা বানিয়েছি তার পেছনে মধ্য স্বত্ব চেতনা কাজ করেছে।
অনেক ব্যক্তিগত কথা বলা হয়ে গেল।ফিরে আসি পার্থদার চেম্বারে ।
আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম।
মুহূর্তেই পার্থদা তৎপর হয়ে উঠলেন ।কয়েকটা ফোন করলেন।
বললেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। স্টিলে যাবে।স্টেশনে গাড়ি থাকবে।সেই গাড়ি তোমাদের  আমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে।রান্না করা চলবে না । অশোক মহান্তিকে তোমার পরিচয় জানালেই  ও সব ব্যবস্থা করে দেবে।অশোক মহান্তিকে আমি নামে চিনতাম । ওর পান্থসখার কথাও জানা ছিল।
পার্থদার  একটা কথাতেই সেবারের পুজো সরে গেল ঝাড়গ্রামে ।




৮৫•দ্বিতীয় পর্ব

অশোক মহান্তি কত কম বয়সে চলে গেল।তরুণ কবি  অংশুমান করে খুব ভালো একটা গদ্য লিখেছে এই সময় দৈনিক পত্রিকার এডিটোরিযাল  পেজে।এই সময় এবং অংশুমানকে ধন্যবাদ । যেকোনো আন্তরিক লেখা পড়লেই মনে হইল, এটা তো অনেক আগেই  আমার লেখার কথা ছিল । যা লিখিনি, তেমন লেখার পাঠক হবার অধিকার তো আমার আছে।সেই অধিকার কেউই কেড়ে নিতে পারবে না ।
ফিরে যাই ঝাড়গ্রামে , সেবার পুজোয় যেখানে গিয়েছিলাম । স্টেশনে নামার পর গাড়ি ছিল । আমাকে পরিচয় দিতে হয়নি । গাড়ির ড্রাইভার চিনে নিয়েছিলেন।
সুদীর্ঘ সব শালগাছকে সাক্ষী রেখে আমরা পৌঁছে গেলাম পার্থদার বাড়ি। বাড়িতে ঢুকেই বুঝতে পারলাম  আমরা ঠিকানা ভুল করিনি । এখানেও বই আর বই । আমি আর কিছু চাইনি।
আমরা বলে থাকি, প্রিয় বই প্রিয় সঙ্গী । বই  আর শালগাছ, আমি তো শাহেনশাহ ।
পার্থদা যে অশোক মহান্তির কথা বলেছিলেন ।তো যেতে হবে।সকলের টিফিন সঙ্গে ছিল ।খাওয়া হল। এবার চা-পানের জন্য বাইরে যেতে হবে।  এই চা-পান কিন্তু চা এবং পান নয়।শুধুই চা এবং তা পান করা । তখন যে আমার পান-যোগ ছিল, তা ঘোষণা করাটা জরুরি নয়।
রথদ্যাখা  এবং কলাবেচা যে কেবল কথার কথা নয়, তা প্রমাণ করার জন্য চা-পান এবং অশোক মহান্তিকে জুড়ে দিলাম ।
পান্থসখার সঙ্গে পরিচয় নেই,ঝাড়গ্রামে এমন একজন ও নেই । অতএব পৌঁছে গেলাম ।
অশোক সম্ভবত আমাকে চিনতো,নামে। একসময়ে বন্ধু সমীরণ মজুমদারের পত্রিকা অমৃতলোক- এ বড়ো বড়ো গদ্য লিখেছিলাম, সম্ভবত সেই সূত্রেই পরিচিতি ।
অশোক-কে বলেছিলাম --- আমি প্রভাত চৌধুরী । এটুকুই যথেষ্ট ছিল ।
অশোকের  মতো বন্ধুদের জন্য নিজের হৃদয় খুলে রাখা কবির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এটা আমার  উপলব্ধির কথা । মুহূর্তেই আমাকে নিজের দাদার আসনে বসিয়ে নিয়েছিল ।
অশোক-কে ঝাড়গ্রাম আসার পুরো কাহিনি শোনাতে হল।
প্রথমেই বলবো,  আপনি থাকবেন পার্থদার বাড়ি, কিন্তু খেতে হবে আমাদের বাড়িতে।
আমি সেসময়ে মফসসলের সব কবির ঠিকুজি -কুষ্ঠি জানতাম ।বলেছিলাম, তোমাদের বাড়িতে অবশ্যই খাবো,তবে প্রতিদিন নয়। একদিন রাতের খাবার খাবো।রুটি  আলুর দম। আর আলুর দম রান্না করবো আমি ।
অশোকের রাজি হওয়া ছাড়া  উপায় ছিল না ।
আমি আমার প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম ।
অশোকের স্ত্রী  আমার হেল্পার ছিল । আমার জানা ছিল বন্ধুবর কালীকৃষ্ণ গুহ-র সুপারিশের কারণে অশোকের স্ত্রীর চাকরি প্রাপ্তি ।না, কালীকৃষ্ণ  একথা বলেনি ।আমি জানতাম, সেজন্য লিখেও দিলাম ।
সেদিনের সেই অভিনব ডিনার -পর্বের সব মনে পড়ছে, কিন্তু  অশোক-কে অনুপস্থিতির তালিকায় রেখে দিতে হচ্ছে, এমনটা কেন হল
যতদিন বাঁচবো ততদিন  অশোক মহান্তির রান্নাঘরের  এক রাতের রাঁধুনি হিসেবে যেন স্বীকৃতি  পাই,সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই কথাগুলি লিখে রাখলাম ।

সেবার পার্থদার বইপত্র থেকে খুঁজে পেয়েছিলাম কয়েকটি ছোটো পত্রিকাতে প্রকাশিত  আমার কবিতা, জেরক্স করে নিয়ে এসেছিলাম, পার্থদাকে দেখিয়ে ছিলাম ।




৮৬•দ্বিতীয় পর্ব

পর পর দুদিন সিরিয়াল নাম্বার ৮১ হয়ে গিয়েছিল ।এতে করে কেউ যদি ভেবে বসেন, আমি ৮১- তেই আটকে থাকতে চাই, তিনি ভুল ভাবছেন ।
আমরা কবিতা পাক্ষিক ১ থেকে ৫০০ পর্যন্ত সংখ্যা বিরতি ছাড়াই ধারাবাহিক ভাবে বের করে গেছি । আমার  অতিবড়ো নিন্দুকও জেনে গেছেন আমার নিজের সম্পর্কে অহংকারের ঘোষণাপত্র টির কথা । অতএব সুন্দরের দিকে শুরু তে থেমে যাবে কেন ।এখনো তো আসল কাহিনিতে ঢোকা হয়নি । কাল-পরশুর মধ্যে পৌঁছে যাবো কবিতা পাক্ষিক -এ।
ঝাড়গ্রামের কথা  এখনো ফুরোয়নি ।ঝাড়গ্রামের পরের কথা ।পরের কথা আগে লিখলে গীতাঞ্জলি  অশুদ্ধ হয়ে যাবে না । অতএব ঘটনা ঘটার অনেক আগেই এসে পড়ছে উল্লাস।
এই উল্লাস- এর পদবি চট্টোপাধ্যায়। অর্থাৎ উল্লাস চট্টোপাধ্যায় ।
এই উল্লাস আবার তরুণ  কবি ঠাকুরদাস চট্টোপাধ্যায়ের দাদা।উতল হাওয়া পত্রিকার সম্পাদক ।কাজেই উল্লাসের  আমাকে নিয়ে উল্লাস কিছুটা বেশি হবে, তা তো জানা সিলেবাস ।
কর্মক্ষেত্রে তখন উল্লাস বি ডি ও ।  আগে রানিবাদে ছিল, পরে ঝাড়গ্রামে ।
রানিবাদের এখন বলছি না ।বলবো ঝাড়গ্রামের কথা ।
সেবার উল্লাসের বাসনা হয়েছিল আমাকে দুর্গা পুজোর বিচারক করবে । ব্যাপারটা  একবার ভাবুন তো। এর থেকে বড়ো স্বজন পোষণের উদাহরণ কেউ দিতে পারবেন না । আমার মতো একজন নগণ্য কবিতালেখক কিনা বিচারক।
আমিও সাত-পাঁচ ভেবে না দেখে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ।
কিন্তু  একটা সমস্যার কথা বলেছিলাম । আমি পুজোতে কাদাকুলিতে থাকবো। উল্লাস বলেছিল--- তাহলে তো আরো ভালো হল। ওখান থেকে ডাইরেক্ট গাড়িতে চলে আসবেন । ওই গাড়ি তেই পরদিন ফিরে যাবেন।
উল্লাসের  একটা বড়ো গুণ ও খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে ।
যে ঝাড়গ্রামে পার্থদার  অনুগ্রহে প্রথমবার গিয়েছিলাম, শেষবার অনুগ্রহ টি কমন থাকলো, ব্যক্তির নামটা বদলে গেল। পার্থদার জায়গাটার দখল নিল উল্লাস।
এই জীবনে ঠিক কত মানুষের  অনুগ্রহ -কে সম্বল করে টিকে থাকতে হল, তা ভাবতে বসলে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়।
সেবার অনেক তরুণ কবিজনের সঙ্গে দ্যাখা -সাক্ষাৎ হয়েছিল ।নামের তালিকা দিচ্ছি না, কোনো নাম যদি বাদ পড়ে যায়, তাহলে বিড়ম্বিত হতে হবে।

যে সময়ে কবিতা থেকে দূরে ছিলাম তখন যে খুব সুখে ছিলাম  এমনটা নয়। তখন রাজ্যে বামজমানা। একে আমার বা বামজমানা বলে মনে হত না ।মনে হত সিপিএমের রাজত্ব ।দ্বিতীয় যুক্ত ফ্রন্টের  আমলেই সিপিএম অন্য শরিকদলগুলির চামড়া গুটিয়ে দিয়েছিল, মেরুদণ্ড সোজা ভেঙে দিয়েছিল ।যাতে তারা সিপিএমের অনুগত থাকতে বাধ্য হয়।
যে মানুষ জুতোর ফিতে বাঁধার সময় ছাড়া নতজানু      হয় তাকে করুণা করতে শেখো।এই বোধই তখন মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে ।
কাজেই ভিতরে ভিতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে  পড়ছিলাম, একমাত্র রুহিদাসের জন্য সুতোটা ছেঁড়া সম্ভব হয়নি।




৮৭•দ্বিতীয় পর্ব

কোনো কবিতার জন্য কি কখনো সূর্যের  আহ্নিকগতির কোনো পরিবর্তন হতে পারে ? এই আপাদমস্তক নিরীহ প্রশ্নটি  আমাকে ব্যাকুল করলো কেন? তা বুঝতে পারছি না । তবে এই ব্যাকুলতা বুঝিয়ে দিচ্ছে  আমি কবিতা পাক্ষিক নামক স্বপ্নভূমির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।

আমার বন্ধু তথা কমরেড রতন বসু মজুমদার বাংলাভাষা কেন্দ্রিক  একটা সংগঠন করেছিল । রতন চাকরি করতো অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাঙ্কে। ওই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
রতন হঠাৎই  একদিন আমার  অফিসে এসে হাজির । এবং টেনে নিয়ে গেল তৎকালীন পূর্ত দফতরের মাননীয় মন্ত্রী ।
রবীন্দ্রসদন - এর সামনে যে আইল্যান্ড ছিল সেখানে  একটা ট্যাবলেট বসাতে চায়, তার সরকারি অনুমতি প্রয়োজন, সেকারণেই যতীন চক্রবর্তীর কাছে যাওয়া ।
অনুমতি পাওয়া গেল।তার পরের কাজ ট্যাবলেটটা বানাতে দিতে হবে । লালবাজারের কাছে একটা দোকানে সেটা বানাতে দেওয়া হল।
যথা সময়ে তৈরি ট্যাবলেট পৌঁছে দিলাম নির্দিষ্ট জায়গায়।তখন আমি রতন-নেতার আজ্ঞাবহ ।
অনুষ্ঠানের দিন ছিল 21 শে ফ্রেবুয়ারি। 19 কিংবা 20 তারিখে রতন বলল--- তুই তো এক সময়ে কবিতা লিখছিস,চলে  আয় শহিদ মিনার ময়দানে।সুনীলদা থাকবেন ।জমায়েতের পরে মিছিল হবে।আপনারা অনেকেই জানেন আমার একটা পা নাচের অন্যটা মিছিলের ।
আমি রাজি হয়ে গেলাম । বললাম,  অবশ্যই যাবো।কিছু না হোক , সুনীলদার সঙ্গে দ্যাখা তো হবে।

ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম । সুনীলদার কথায় উষ্ণতা দেখতে পেলাম । আমি যে বিশেষ ধরণের চোখ নিয়ে জন্মেছি, সেই চোখে উষ্ণতা দ্যাখা যায় যেমন ,তেমনই অবজ্ঞাও দেখতে পাই । এই বাড়তি সুযোগ টুকু আমার প্রাণের ঠাকুর আমাকে দিয়েছেন । এটা নিয়ে যাঁরা হাসাহাসি করতে চান,করতে পারেন। আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত হব না । আমার লেখা আমি চালিয়ে যাবো।এখন তো আমি হোমগ্রাউন্ডে খেলছি কিংবা লিখছি । এই মাঠের প্রতিটি বিপ্রতীপ কোণের মাটি যেমন আমার চেনা, তেমনই  এই মাঠের প্রতিটি 4 G ভার্সন আমার হাতের তালুতে।
সুনীলদার সঙ্গেই দু-চার কথার পর এগিয়ে গেলাম ।এক জায়গায় অমর মিত্র কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল। ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে চিনতে পেরেছে বোঝা গেল। একজন সুন্দরী মহিলা র সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল অমর। আমার সঙ্গে করালো না ।কেনই বা করাবে।কী পরিচয়  আমার । একসময়ে লিখতাম ।তার বেশি কিছু নয় তো।
জীবনে এর থেকে বেশি  অপমানিত কখনো হইনি। সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম  আমার একটা পরিচয় চাই ।
এই ঘটনাটির কথা বহুবার বহু লেখাতে লিখেছি ।কিন্তু কখনোই অমর মিত্র -র নাম উল্লেখ করিনি ।যেখানেই কবিতা পাক্ষিক কেন করতে গেলাম, প্রশ্ন টি এসেছে ,সেখানেই এক গল্পকার বলে উল্লেখ করেছি ।  
আজ অমরের নাম প্রকাশের কারণ অমরকে ধন্যবাদ জানাবার জন্য ।সেদিন যদি এই ঘটনাটি  না ঘটতো তাহলে আমি মিছিল থেকে ফিরে হয়ত তাসের দেশে চলে যেতাম আর তাহলে আজও বাংলাকবিতা আধুনিকতার মাঠেই কানামাছি ভোঁ-ভোঁ খেলে যেত।কবিতা পাক্ষিক -এর মাধ্যমে বাংলাকবিতার যে পরিবর্তন হয়েছে, সেটা হত না । অতএব  আমার যাবতীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে একমাত্র অমর মিত্র -র তৎপরতার কারণে । এটা অস্বীকার করবো কীভাবে ? আমি চিরকাল ঋণী থেকে গেলাম অমরের কাছে।

পরদিন ঘুম থেকে  উঠেই পবিত্রদার বাড়ি ।  22 / বি প্রতাপাদিত্য রোড।পবিত্রদা তখন সবে ঘুম থেকে উঠেছেন। আগের দিনের সমস্ত কিছুই জানিয়ে বললাম ----সাপ্তাহিক কবিতার পত্রিকা করবো।অনেকটা পেছিয়ে পড়েছি ।দৌড় দিতে হবে। নাহলে মেকাপ হবে না।একারণেই সাপ্তাহিক ।
পবিত্রদার প্রথম উত্তর ছিল, তুমি কবিপত্র-র দায়িত্ব  নাও।
আমি বলেছিলাম, কবিপত্র যদি আমি করি,লোকে কিন্তু বলবে,পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কাগজ।বুড়ো বয়সে লোভ হয়েছে ,লোকে বলুক প্রভাত চৌধুরীর কাগজ।
পবিত্রদা শেষমেশ অনুমতি দিলেন।তবে ত্রৈমাসিক করতে বললেন। আমি যে পেছিয়ে পড়েছি,এটা  ঠিক উপলব্ধি করতে পারছিলেন না।
আমি সাপ্তাহিক -এ অটুট ছিলাম ।পবিত্রদা মাসিক-এ নেমে এলেন। এভাবেই  দড়ি টানাটানি চলল কিছুটা সময়।
অবশেষে আমি বললাম আমার কথাও থাক,আপনার কথা ও থাক। পাক্ষিক হোক।
কবিতা পাক্ষিক ।





৮৮•দ্বিতীয় পর্ব

কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পবিত্রদা  এবং আমি ।আর কারো পরামর্শ কিংবা মতামত নেবার প্রয়োজন মনে হয়নি।
আমার মনে হয়েছিল  একটা উপদেষ্টা মণ্ডলী থাকুক ।নাম ভেবেছিলাম --- আলোক সরকার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত  এবং পবিত্র মুখোপাধ্যায়, এই তিনজন ।
সেমতো প্রথমেই গেলাম আলোকদার বাড়ি ।তখনো আলোকদা রাসবিহারীর বাড়িতে । সব জানালাম। আলোকদা বললেন--- আমি রাজি নই ।কারণ তুমি হয়তো  আমার দেওয়া সব কবিতা ছাপবে, কিন্তু তুমি যে কবিতাগুলো প্রকাশ করবে তার সবগুলোই যে আমার পছন্দের হবে,তেমনটাই নয়। আমার অপছন্দের বহু কবিতা ছাপা হবে যে পত্রিকাতে তার আমি উপদেষ্টা হব কীভাবে ।
আমি ভেবে দেখলাম  আলোকদার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল ।
কিন্তু ভৃমেন্দ্র গুহ যখন দরগা রোড নামে পত্রিকাটি করেছিলেন, তখন কিন্তু  ওই পত্রিকার সঙ্গে আলোচনাও যুক্ত ছিলেন । দরগা রোড পত্রিকাটি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা প্রশ্ন করতেন ---দরগা রোড- এ যা ছাপা হত তার সঙ্গে  আলোকদার পছন্দের কবিতা কতটা থাকতো।
আলোকদা রাজি না হবার ফলে উপদেষ্টা মণ্ডলী বাদ দিতে হল।
এদিকে আমি তখন পণ্ডিতিয়া রোডে মিস্টার দাশগুপ্তের ছেলে অঙ্ক পড়াই।মিস্টার দাশগুপ্ত ছিলেন বেঙ্গল চেম্বার  অফ কমার্সের সেক্রেটারি । ওই বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতেন জ্যোছন ঘোষদস্তিদার,সপরিবারে ।
আমার ছাত্র সূর্যনীল ছিল ছোটো ছেলে।সাউথ পয়েন্ট -এর ছাত্র ।টিউশনিটা পেয়েছিলাম  আমার প্রথম বন্ধু দীপংকর সরকার এবং কৃষ্ণাদির যৌথ প্রচেষ্টার ফলে।সূর্যনীলের দাদা তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ।ওর হাতেই প্রণবেন্দুদাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। প্রণবেন্দুদা সেই চিঠিতেই সন্মতি জানিয়ে ছিলেন । পবিত্রদার সঙ্গে  আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হল প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রণবেন্দুদার নাম ছাপা হবে । তেমনটাই হয়েছিল ।
আমি পার্টি এবং গণসংগঠনের কাজটা মন দিয়ে করেছিলাম, কবিতা পাক্ষিক -এর একটা সাংগঠনিক রূপ দিতে চেয়েছিলাম ।জেলায় জেলায় যেতে হবে।সিদ্ধান্ত নিলাম ।
এর মধ্যেই কবিতা পাক্ষিক -র লোগো বা নামাঙ্কন করার দায়িত্ব নিল আমার তৃতীয় ভাই শিবু,শিব চৌধুরী ।চার-পাঁচ টি নামাঙ্কন করে দিল শিবু।সেগুলি নিয়ে যাওয়া হল বিভিন্ন জনের কাছে ।
কে কোনটি পছন্দ করছেন,তা নোট করা হল।রীতিমতো একটা প্রমোশন-পলিসির মতো,অনেকটা । এর ফলে প্রকাশের অনেক আগেই অনেকে জেনে গেলেন,মুক্তি প্রাপ্ত পত্রিকাটির নাম কবিতা পাক্ষিক ।





৮৯•দ্বিতীয় পর্ব

নাম এবং প্রকাশকাল ঠিক হয়ে যাবার পর ,তাছাড়া নামাঙ্কন- এর দায়িত্ব শিবু গ্রহণ করার পর শরীরের মধ্যে প্রবেশ করেছিল আরব দেশের কয়েকটি তরুণ টগবগে ঘোড়া।আমাকে প্রায় কিছুই করতে হয়নি।যা করার ওই ঘোড়াগুলিই করতো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যেতাম মাত্র । ঠিক করেছিলাম শনিবার ছ-টার মধ্যে পৌঁছে যেতে হবে ছোটো ব্রিস্টলে । ছোটো ব্রিস্টল হল শ- ব্রাদার্স ।মেট্রো গলির কম পয়সার বার।
এই বারে যাঁদের সঙ্গ এবং পরামর্শ পেয়েছি তার মধ্যে প্রধানতম হলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়। তাছাড়া তুষার চৌধুরীর সঙ্গলাভও ছিল পরম সৌভাগ্যের ।তার আগে  অর্থাৎ ছোটো ব্রিস্টলে ঢোকার আগে চলে যেতাম কফি হাউসে।ওখানেও পবিত্রদা থাকতেন। তার অর্থ হল কবিপত্র -র পবিত্র -প্রভাত জুটি । কবিতা পাক্ষিক -এর শুরুতে অনেক দিন পর্যন্ত  এই জুটি অক্ষুণ্ণ ছিল ।
মনে রাখতে হবে আমার গায়ে তখনো কমিউনিস্ট পার্টির গন্ধ ।পত্রিকা চালাতে গেলে মজবুত সংগঠন চাই, এই ধারণা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল ।অতএব সেই সংগঠন তৈরি কলকাতাতে বসে থাকলে হবে না ।বাইরে বেরুতে হবে।কাছাকাছি জেলা বলতে প্রথমেই বাঁকুড়ার কথা মনে এলো।তাও বাঁকুড়া শহর নয়।ছাঁদারে । রাজকল্যাণ চেল-কে খবর দিলাম। আর উৎপল চক্রবর্তী -কে। ওখানেই প্রথম জানতে গেলাম কবিতা পাক্ষিক -এর কথা । অনেকেই এসেছিল সেই প্রস্তুতি -সভায়।সবটাই সম্ভব হয়েছিল রাজকল্যাণ চেলের তৎপরতার জন্য ।যারা এসেছিল তাদের মধ্যে প্রণব চট্টোপাধ্যায় স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যসাধন চেল  আরো বেশ কয়েকজন উৎসাহী তরুণ কবিজন।নামগুলি স্মৃতি হাতড়ে বের করলাম ।কিছুটা অদলবদল হতেই পারে ।স্বপন ভালো বলতে পারবে ।রাজকল্যাণ তো পারবেই।
সভা শেষ হবার পর বুঝতে পারলাম বাঁকুড়া আমার সঙ্গে  আছে। মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন -কে পেয়েই ধরে নিলাম বাঁকুড়া  আমার হয়ে গেল ।ভাবনার মধ্যে কল্পনার প্রচুর প্রভাব ছিল ।স্বপ্ন যে ছিল, সেটাও কি লিখে রাখতে হবে? জানি না, জানতেও চাই না ।
বাঁকুড়ার পরে বর্ধমান । এবার খোদ বর্ধমান শহরে।৩৭ কালনা রোডে।কবি-শিল্পী শ্যামলবরণ সাহা-র বাড়িতে। বাড়িটির নাম চিত্রকল্প । এরপর যে অংশটা লিখছি,তার তথ্য সংগ্রহের জন্য ফোন করতে হয়েছিল  অরবিন্দ সরকার মুহম্মদ মতিউল্লাহ এবং নিয়াজুল হক-কে।
নিয়াজুল তখন ছিল আমার সহকর্মী ।কবিতা পাক্ষিক নামে প্রকাশিতত্ব পত্রিকার বর্ধমানের প্রস্তুতিসভার যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল নিয়াজুল। এর আগে আমি শ্যামলবরণ-কে চিনতাম না।এমনকি দীপ সাউ-কেও চিনতাম না ।




৯০•দ্বিতীয় পর্ব

গতকালের আমার যে পোস্টটি ছিল, তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে নিয়াজুলের পোস্টটি ।তাহলে অনেক সূত্র  উঠে আসবে।
নিয়াজুল WBCS দিয়ে নতুন পোস্টং পেয়েছিল বর্ধমানে।থাকতো হাউজিং-এ। নতুন চাকরি পেলেও নিয়াজুল আমাকে তথা আমাদের ছাড়তে পারেনি।
কবিতা পাক্ষিক প্রস্তুতিপর্বে নিয়াজুল-ই বর্ধমানের প্রস্তুতিসভার প্রস্তাব দিয়েছিল ।আমি একাই পৌঁছে গিয়েছিলাম বর্ধমান ।গিয়েছিলাম বাসে।নেমে ছিলাম তিনকোনিয়া বাসডিপোতে।তখন ওখানেই ছিল বাস-এর  আস্তানা।ওখান থেকেই বাস আসাযাওয়া করতো।
আমি কি ছাঁদার থেকে বর্ধমান গিয়েছিলাম ? এটা নিশ্চিত লিখতে পারছি না।কলকাতা থেকে গেলে তো ট্রেনে  যেতাম ।তাছাড়া তখন তো কলকাতা -বর্ধমান বাস চলাচল শুরুই হয়নি ।ধরে নিচ্ছি, ছাঁদার থেকে ভোরের বাসে চেপে পৌঁছে গিয়েছিলাম বর্ধমানের তিনকোনিয়া বাস গুমটি।ওখানে অপেক্ষা করছিল নিয়াজুল।
আমি বাস থেকে নামতেই  এগিয়ে এসেছিল ।সঙ্গে এক সদ্য যুবকও ছিল ।নাম জানলাম মুহম্মদ মতিউল্লাহ । অর্থাৎ মতি।একটা নাম উঁকি দিচ্ছে ।সেই নামটি হল দীপ সাউ।পরবর্তী কালে যে ছিল কবিতা পাক্ষিক -এর বর্ধমানের  অভিভাবক । আমার মনে হচ্ছে দীপও ছিল ।
আমি  আর দীপ  এক রিক্সায়।নিয়াজুল -মতি তাদের নিজস্ব দ্বিচক্রযানে।না, মোটর-চালিত বাইকে নয়।সাইকেলে ।তখন এত মোটরবাইকের প্রাবল্য ছিল না।আমরা  অনেক গরীব ছিলাম ।অনেক দূষণমুক্ত।
দীপ সাউ প্রকাশ করতো এখন নিদাঘ।পঁচিশে বৈশাখের পত্রিকা ।ট্যাবলয়েড  আকারের।যদিও আমি তখনো এখন নিদাঘ-এর লেখক তালিকায় অনুপস্থিত ছিলাম ।
সাইকেল-রিক্সা আমাদের পৌঁছে দিল ৩৭ কালনা রোড,চিত্রকল্প চিহ্নিত বাড়িটির দোরগোড়াতে।
শ্যামলবরণের খুদে ছাত্র -ছাত্রীরা তখনো কেউ কেউ তাদের  শিক্ষাক্ষেত্র-কে রক্ষা করতে ব্যস্ত ।শ্যামলবরণ ওদের ছুটি দিয়ে দিল।চিত্রকল্প পরিণত হল সভাগৃহে।
প্রথমেই জানিয়ে রাখতে চাই শ্যামলবরণ এবং সঞ্চয়িতা-র মতো অতিথিবৎসল কবি দম্পতির সন্ধান পাওয়া কবিতা পাক্ষিক তথা আমার ভাগ্যগুণ।খুবই  বড়ো হৃদয়ের মানুষ শ্যমলবরণ। আমাকে এমনভাবে গ্রহণ করেছিল যেন বহুদিনের চেনা-পরিচয়।

শ্যামলবরণ সেদিন জানিয়েছিল কবিপত্র -র শিল্পসংখ্যার কথা।ওই সংখ্যাটি  আমি বর্ধমানের একটি স্টলে দিয়ে এসেছিলাম ।ওই স্টল থেকেই শ্যমলবরণ ওই সংখ্যাটি সংগ্রহ করেছিল।
বর্ধমানে নিয়ে গিয়েছিলাম শিবুর করা কবিতা পাক্ষিক -এর নামাঙ্কনগুলো।ওখানে উপস্থিত সকলের মতামত নোট করে নিয়েছিলাম।
কারা করা ওই প্রস্তুতিসভাতে হাজির ছিলেন তা সবটা মনে পড়ছে না। তবে এর আগে যাদের কথা লিখেছিলাম, অর্থাৎ নিয়াজুল হক,মুহম্মদ মতিউল্লাহ, দীপ সাউ,  অরবিন্দ সরকার, শ্যামলবরণ সাহা-র, সঞ্চয়িতা কুণ্ডু তো ছিলই ।রমেশ তালুকদার, মহম্মদ রফিক,কুমুদবন্ধু নাথ--- এদের মধ্যে কেউ কেউ কি ছিল না,তা জোর দিয়ে বলতে পারছি কই ।
প্রতিষ্ঠান -বিরোধিতা এবং লিটল ম্যাগাজিন কনসেপ্ট বর্ধমানে যতটা তীব্র ছিল, পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো জেলাতেই ততটা তীব্র ছিল না ওই সভার সকলেই নতুন পত্রিকার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিল। এর ফলশ্রুতিতে  আমি ফিরে এসেছিলাম কবিতায়।তার প্রমাণ পরবর্তী কোনো এপিসোডে।
সভা শেষ হবার পর গিয়েছিলাম শাঁখারিপুকুর হাউজিং-এ, নিয়াজুলের বাড়ি।
নিয়াজুলের বিয়েতে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম অনেকটা হাঁটাপথে।পরে ওর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী -কে শ্যামসুন্দর কলেজে বাংলা  অনার্সে ভর্তির জন্য আলোক সরকার -কে অনুরোধ করেছিলাম ।আলোকদা সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলেন ।

নিয়াজুলের বাড়িতে পঞ্চ ব্যঞ্জন সহযোগে ভাত খাওয়ার পর কতক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলাম সেটা লিখে রাখাটা নিশ্চয়ই জরুরি নয়।





৯১•দ্বিতীয় পর্ব

বর্ধমান থেকে ফিরে আসার পর যে-কটি উল্লেখ করার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ছিলাম, তার মধ্যে যেগুলি  উদ্ধার করতে পারলাম, সেগুলি লিখে রাখার চেষ্টা করছি ।
সুজিত হালদার নামে  এক সদ্য যুবক এসে উপস্থিত হয়েছিল হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে । ওর সঙ্গে গতকাল দ্যাখা হয়েছিল সোনারপুর যাওয়ার সময়,ট্রেনে । ওর কাছে  আমার জানার ছিল,কে ওকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল। ও নাম বলতে পারেনি।বলেছিলেন, ওর মামার বন্ধু ।তবে কমিউনিস্ট পার্টির কেউ ছিলেন মামার সেই বন্ধু ।
উৎসাহী তরুণ।
সুজিত তখনই ঠিক করে নিয়েছিল,  ওকে লেখার মাধ্যমেই জীবিকার সন্ধান করতে হবে।সুজিতের সেই বাসনা পূর্ণ হয়েছে। ও এখন শিশু কিশোর আকাদেমি তে কাজ করে।
এই সুজিতের সঙ্গে  একদিন পৌঁছে গেলাম জয় গোস্বামী -র বাড়ি। জয়-কাবেরী তখন যোধপুর পার্কে থাকতো।
জয়-এর বাড়িতে আমাদের আগেই উপস্থিত ছিলেন বিষ্ণু দে-র কন্যা ।জয়  ওনার সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে কী বলেছিলেন, সেটা প্রকাশ্যে আনাটা খুব জরুরি নয়।নগণ্য সেই কথাটি তোলা আছে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতির না লেখা কথার ডাইরিতে ।
জয়-কে শিবুর করা কবিতা পাক্ষিক -এর নামাঙ্কনগুলো দেখিয়ে ছিলাম । জয়ের পছন্দটি নোট করেছিলাম ।
জয় যে আমাকে চিনতে পেরেছিল  এতেই আমি কৃতার্থ হয়েছিলাম ।
শান্তিময় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো অনেকদিনের সম্পর্ক । শান্তিময় কবিতা পাক্ষিক শুরুর দিকে প্রধান ভূমিকায় ছিল । রৌরব-এর প্রথম সম্পাদক শান্তিময়ের মাধ্যমে নাসেরকে পেয়েছিলাম ।সেসব পরে বলা যাবে ।
ঠিক  হল---একটা পোস্টার ছাপতে হবে।আমি যুক্ত  কমিটির কর্মী। পোস্টার আমাদের হাতিয়ার ।কাজেই পোস্টারের ম্যাটার এবং সাইজ ঠিক করতে হল নিজেকেই।এখন যেমন নাসের করে সবটা । আমি কেবল ঘাড় নাড়ি মাত্র ।তখন করা এবং ঘাড়নাড়া দুটোই আমাকে করতে হয়েছিল ।আমাদের  ইউনিয়নের পোস্টার ছাপা হত অশোক লিথো থেকে ।কেশব সেন স্ট্রিটে।
কবিতা পত্রিকার জন্য ছাপা পোস্টার, এটাও অভিনব। অশোক লিথো -র সঙ্গে  আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল ।শিল্পী ভদ্রলোকের নামটা মনে নেই ।উনি খুব যত্নের সঙ্গে ডিজাইন করে দিয়েছিলেন।তার জন্য কোনো দক্ষিণা দাবি করেননি ।বলেছিলেন, কবিতার পত্রিকা, টাকা নেবো কীভাবে ।কোথায় ছাপা হবে ? সেই প্রশ্নের সমাধান হয়ে গিয়েছিল সহজেই । যুক্ত কমিটির মুখপত্র যুক্ত কমিটি নামের পত্রিকাটি ছাপতেন কাশীবাবু।ভুবন ধর লেনের প্রিন্টিং সেন্টার প্রেস। ওখানেই ছাপা হবে কবিতা পাক্ষিক । তখন ছাপা মানে কম্পোজ  এবং ছাপা ।
প্রস্তুতিপর্বের সমস্ত কাজ শেষ ।
এবার করতে হবে  কী কী থাকবে পত্রিকাতে। পৃষ্ঠা বিন্যাস  এবং মলাট । এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিলাম ।





৯২•দ্বিতীয় পর্ব

এবার কবিতা পাক্ষিক - এর পরিকল্পনা নিয়ে কিছু স্মৃতি লেখা যাক। আর্যনীল বর্ণিত স্মৃতিলেখার সঙ্গে স্মৃতি লেখা-র যে পার্থক্য তা চোখে দেখা যায় না ।কেননা স্মৃতি  এবং লেখা-র মধ্যে একটা ফাঁকা গাছতলা আছে। যে গাছতলায় বসে থাকে বর্ণময় কয়েকটি মৌমাছি । তাদের সন্তানপালনের নির্দেশনামা। এত কথা নিয়ে কী করতে হবে তা বলতে পারবো না ।তবে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে  বহুরৈখিক হাঁটাহাঁটি , নৌ-যাত্রা।
আমরা যখন কোনো স্কুলে ভর্তি হই, তখন আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি সিলেবাস । আমার হাতেও নির্দিষ্ট একটি সিলেবাস ছিল ।কিন্তু - পর আরো দু-চার টি কিন্তু যোগ করলে যোগফলের কি বিশেষ কোনো পার্থক্য ধরা সম্ভব হবে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।আপাতত সেই সম্ভাবনার করিডোরটিকে অ্যাভয়েড করতে চাইছি ।কারণ আমাকে এখন কবিতা পাক্ষিক - এর সূচি বানাতে হবে । এর জন্য আদর্শ জায়গা হল ছোটো ব্রিস্টল । এবং পরামর্শ দাতা পবিত্র মুখোপাধ্যায়।
প্রথমেই ঠিক হল ---পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা হবে১৬। প্লাস কভার ৪ পৃষ্ঠা । প্রয়োজনে সেটা বাড়ানো হবে।
এই ১৬ পৃষ্ঠার বিন্যাস নিয়ে ভাবা হল।
প্রথম পৃষ্ঠায় থাকবে---এই পক্ষের ভাবনা ।কয়েকজন কবির নাম ঠিক করা হল,ভাবনা লেখার  জন্য ।নামগুলি হল---প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুধীর করণ,  আলোক সরকার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের নাম।
ভাবনার সময়ে  এই পর্যায়-ক্রম ছিল না ।যেরকম ছাপা হয়েছিল সেই পর্যায়-ক্রমে লিখলাম ।
দ্বিতীয় নিয়মিত বিভাগ ---প্রসঙ্গ : সম্পাদনা ।বিভিন্ন  সম্পাদককে অনুরোধ করা হবে সম্পাদনা নিয়ে কিছু কথা লেখার জন্য । প্রায় প্রতিটি  উল্লেখযোগ্য পত্রিকা - সম্পাদকের কাছে আমাদের যেতে হবে ।সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা  আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কৃত্তিবাস, শতভিষা, কবিপত্র, সাম্প্রতিক, বাল্মীকি, ক্রান্তদর্শী, অমৃতলোক, রক্তমাংস,  সময় ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকদের ,তাঁদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ।যদিও সেই সময়ে কৃত্তিবাস, শতভিষা, সাম্প্রতিক, ক্রান্তদর্শী পত্রিকগুলির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, যা ছিল তা  ইতিহাসের আলোচ্য-সূচি। তবু আমরা ওই পত্রপত্রিকার ভূমিকার কথা মাথায় রেখে এই কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলাম ।
ফলশ্রুতিতে কবিতা পাক্ষিক পেয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আলোক সরকার, কাননকুমার ভৌমিক, কালীকৃষ্ণ গুহ প্রমুখ  বিশিষ্ট জনের সম্পাদনা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাগুলি।
এই প্রসঙ্গে  একটা কথা খুব বিনয়ের সঙ্গে লিপিবদ্ধ  করে রাখতে চাইছি, তা হল এইসব বিশিষ্ট কবিজনদের  আমরা কখনোই অনুসরণ করতে চাইনি । আমরা চেয়েছিলাম কবিতার  একটা নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করতে। যার তীব্র অভাব ছিল সেসময়ে । এখন কিছুদিন নিয়মিত কবিতার  পত্রিকা প্রকাশের একটা উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি, যা বাংলা কবিতার পক্ষে খুবই স্বাস্থ্যকর।
কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের পরেপরেই  এমনটা হয়েছিল।সেসব জানার জন্য কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের প্রস্তুতিপর্বের আরো অনেক কথা জানতে  থাকুন,পড়তে থাকুন সুন্দরের দিকে ।





৯৩•দ্বিতীয় পর্ব

অনেক কথা  একসঙ্গে ভিড় করে আসছে।একটা কথা বলছেন, আমাকে এখুনি লিখে নাও। অন্য  আরেকটি লেখা বলছে, এখন না লিখলে আমি কিন্তু হারিয়ে যেতে পারি।
আমি কথাসমূহের দিকে  নির্লোভভাবে চেয়ে থাকি ।বলি,আপনারা কেউই হারিয়ে যাবেন না ।এতদিন যখন আপনাদের কাকপাখি - বকপাখির ছানার মতো আগলে  আগলে রেখেছি, তখন কোনো চিল - শকুনের সাধ্য নেই , আমার স্মৃতি থেকে আপনাদের ছোঁ-মেরে তুলে নিয়ে যাবে । আপনারা অপেক্ষা করুন এবং দেখতে থাকুন। কথা -রা আমাকে খুবই বিশ্বাস করে, ভরসাও করে।
এই লেখার পাঠকরা  আমার সঙ্গে আছেন,  আছেন বলেই আমি লিখে যেতে বাধ্য হচ্ছি ।

একটা তথ্য  আরো আগে জানাতে হত।তথ্যটি হল যখন বা যেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কবিতা পাক্ষিক প্রকাশ করা হবে, প্রথমেই শুভব্রত চক্রবর্তী -কে প্রস্তাব দিয়েছিলাম  এই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে থাকার জন্য । শুভব্রত ছিল আমার বন্ধু যোগব্রত চক্রবর্তীর ভাইপো। সেজন্যই কি তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম । নাকি পবিত্রদার ঘনিষ্ঠ ছিল বলে।এখন সবটা  স্পষ্ট নয়। কিছুটা ধোঁয়া আছে। কীসের ধোঁয়া তার ফরেনসিক বিশ্লেষণ করতে চাইছি না । এখন আমার মনে হচ্ছে, লিটল ম্যাগাজিন মানসিকতার জন্যই শুভব্রত কবিতা পাক্ষিক - এর থাকতে রাজি হয়নি।
আর শান্তিময়ের ভূমিকা প্রধান ছিল প্রস্তুতিপর্বে ।কারণ শান্তিময় ছিল  আমার অজ্ঞাতবাস পর্বের বন্ধু । আসলে আমি কী করতে যাবো সেটা ও আগে থেকেই জেনে যেত। আমাকে কিছুই করতে হত না, শান্তিময় সেটা করতে এগিয়ে যেত। একটা নিজস্ব মতামত ছিল, ভাবনা -চিন্তা ও ছিল ।

সুজিত হালদারের কথা তো আগের লিখেছি ।
আরেক জনের নাম ছিল, পিনাকীরঞ্জন ঘোষ। এই পিনাকী স্প্যানিশ পিনাকী নয়।, আমার সহকর্মী ।বাড়ি রানাঘাটে। কবিতা লিখতো না । কবিতাপ্রেমী।
ওকে সঙ্গে রাখার কারণ কি রানাঘাট  একটি জনপদ।খুব জোর দিয়ে না বলতে পারছি না ।
নাকি তখন থেকেই প্রান্তিকের প্রতি  আমার একটা আগ্রহের জায়গা তৈরি ছিল । তা যাই হোক ,সহযোগী সম্পাদক  হিসেবে ছাপা হয়েছিল --- শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, পিনাকীরঞ্জন ঘোষ এবং সুজিত হালদার - এর নাম ।

এই সুজিতের সঙ্গে কথা চালাচালি করে জেনেছিলাম ও চিত্রবাণী-র সঙ্গে পরিচিত ।সেসময়ে  উৎপলকুমার বসু চিত্রবাণী-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।দীপক মজুমদারের সঙ্গেও চিত্রবাণী -র একটা সম্পর্ক ছিল ।
আমরা ঠিক করলাম দীপক মজুমদারের  ওপর একটা ধারাবাহিক গদ্য রাখা হবে।সুনেত্রা ঘটক-কে অনুরোধ করা হবে এই লেখাটির জন্য ।সুনেত্রা -কে আমি চিনতাম না ।তবে ওনার স্বামী সতীনাথ -এর সঙ্গে প্রতিদিন সূত্রে পরিচিত ছিলাম । আর আজকের আমার  অতি পছন্দের অভিনেতা পরমব্রত তো ওদেরই সন্তান ।
সেসব কথা থাক।
সুনেত্রা রাজি হয়েছিলেন দীপকদার  ওপর প্রতিবেদনটি লেখার ব্যাপারে ।

তাহলে পত্রিকার কয়েকটি সংখ্যার কাঠামো রেডি ।
এখন আনুষ্ঠানিক প্রকাশের আয়োজন তো করা  যেতেই পারে ।





৯৪•দ্বিতীয় পর্ব

কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের  আগে কিছুটা হোমওয়ার্ক করতে হয়েছিল ।সেসব কথা না জানানো অন্যায় হবে ।
প্রথম কাজ হল টার্গেট -কবির লিস্ট বানানো । অর্থাৎ কাদের লেখার/কবিতার ছাপা হবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে । এজন্য পৌঁছে গেলাম পাতিরামে। দেখে দেখে কয়েকটি পত্রিকা কিনে ফেললাম ।পত্রিকার তালিকা হল---কমল চক্রবর্তীর কৌরব, সুজিত সরকারের কবিকৃতি ,গৌতম ঘোষদস্তিদারের রক্তমাংস, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের  অন্তরীপ । পত্রিকার নামগুলো কি ঠিকঠাক লিখলাম ? ভুলও হতে পারে ।ভুল হলে মার্জনা করবেন এবং শুদ্ধ করে দেবেন।
এই সদ্য কেনা পত্রিকা গুলো খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। অনেকের কবিতা  আমাকে স্পর্শ করলো। আরো একটা কথা উপলব্ধি করলাম, দশ বছর আগে যে কবিতা লেখা হত,তার অনেক আলপথ পালটে গেছে। অনেক রাস্তার বাতিস্তম্ভ গুলি বদলে গেছে । একটা নতুন কিছু করার জন্য  অনেকেই সংকল্পবদ্ধ। এদের প্রয়োজন একটা নতুন প্লাটফর্ম ।ঠিক করলাম কবিতা পাক্ষিক হোক সেই প্লাটফর্ম ।
তখন যেসব নবনিরীক্ষার পত্রিকা গুলি প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলির কোনোটাই নিয়মিত পত্রিকা নয়।নামে ত্রৈমাসিক হলেও বছরে  একটি -দুটির বেশি সংখ্যা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না । এদের পূর্ণ বিকাশের জন্য চাই একটি নিয়মিত পত্রিকা । কবিতা পাক্ষিক হবে এই কবিদের নিজস্ব পত্রিকা । আমার নির্বাচিত কবিদের লিস্ট  এখনই জানানো টা জরুরি নয়। কবিতা পাক্ষিক বেরুতে থাকলেই জানা যাবে আমি কাদের ওপর নির্ভর করতে চেয়েছিলাম ।

ছাপার জন্য কাশীবাবু, কাশীনাথ পাল।প্রিন্টিং সেন্টার, ১৮ বি, ভুবন ধর লেন।কাশীবাবুর তখন একটাই ছাপার মেসিন।ছোটো ফ্ল্যাট মেসিন।১৬ পৃষ্ঠার জন্য দুবার ছাপতে হবে ।তাতে কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়।কিন্তু মলাট ছাপা হবে কীভাবে ? কোথায়?
মনে পড়ে গেল দুলালদা-র মুখ।হাজির হলাম  এস ডি প্রিন্টার্স-এ।দুলাল দা আমাদের কবিপত্র আমলের । অনেক মলাট ছেপে দিয়েছিলেন  এক সময়ে । দুলালদা বললেন কোনো চিন্তা করতে হবে না । আমি মনে জোর পেলাম ।
কবিতা পাক্ষিক -এর নামাঙ্কনের ব্লক করতে হবে।বিভিন্ন মাপের । সেটাও  আমার জানা সিলেবাস ।স্ট্যান্ডার ফটো এনগ্রেভিনে চলে গেলাম একছুটে । এই একছুটে টা কিন্তু পটলভাঙা থেকে ছুট নয়। ছুটটা ছিল হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে ।হীরালাল বাবু তখনো জীবিত ছিলেন । দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় লেনিন শতাব্দী -র অসাধারণ প্রচ্ছদের ছাপার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হীরালালবাবু। বললেন, কাল  এসে নিয়ে যাবেন।

এখন বাকি থাকলো পোস্টার কাজ।তখনকার হিসেবে   বিগত দশ-দশটা বছর তো প্রায়ই পোস্টার মেরেই কাটিয়েছি ।
হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে  আঁটা বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম । শান্তিময়ের  উদ্যোগে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল। কফিহাউস, ইউনিভার্সসিটি, প্রসিডেন্সি ছাড়া ও বইপাড়ার সর্বত্রই লাগানো হয়েছিল সেই নীল-সাদা পোস্টার।
এর আগে কোনো অবাণিজ্যিক পত্রিকার জন্য  এরকম পোস্টারিং -এর কোনো ইতিহাস নেই।যাঁদের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হচ্ছে, তাঁরা খোঁজ করে দেখতে পারেন ।
সকলেই কফিহাউসের বোর্ডে  একটা হাতে লেখা / আঁকা পোস্টার সাঁটিয়ে তাঁদের কর্তব্য সমাপন করেন। তাঁদের ধারণা নেই কফিহাউসের বাইরেও মানুষজন বসবাস করেন । এদের পরিধানে যদি  কুমোর গভীরে বসবাস করেন লিখে দিতে চাই ---তাহলে আপত্তি কোথায়।




৯৫.

শিরোনাম থেকে দ্বিতীয় পর্ব লেখাটি বর্জন করলাম ।বাহুল্য মনে হচ্ছে বলে ।তাহলে  এতদিন এই বাহুল্য -কে বহন করলাম কেন। এর সহজতম উত্তরটি হল,তখন বাহুল্য মনে হত না ।এখন হচ্ছে ।যাই হোক লেখাটির নাম তো সুন্দরের দিকে । সেটা কিন্তু সশরীরে  উপস্থিত থাকলো শিরোনামে । এর থেকে যেন কখনোই সুন্দর ঝরে না পড়ে সেটা নজর রাখা -ই প্রধান কাজ।

পবিত্রদার হাত ধরে পৌঁছে গেলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি।সকাল সকাল । সুনীলদাকে বললাম কবিতা পাক্ষিক -এর প্রথম সংখ্যার  আনুষ্ঠানিক প্রকাশ আপনাকেই করতে হবে ।সুনীলদা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন।
এরপর বললাম ---কৃত্তিবাস সম্পাদনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে দিতে হবে। তাতেও রাজি সুনীলদা ।
আমরা প্রশ্নপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম, সঙ্গে করে।
সুনীলদা প্রশ্নগুলি দেখে রেখে দিলেন।বললেন, আগামী রোববার নিয়ে যাবে

তার আগের  একটা কথা লেখা হয়নি ।ঠিক করেছিলাম অনুষ্ঠান হবে কালীঘাট মিলন সংঘের ঘরে বা হলঘরে।তখনো মিলন সংঘের এত সুন্দর বাড়িটি নির্মিত হয়নি।বড়ো ঘরটার একদিকে একটা টেবিল টেনিস বোর্ড ছিল ।বাকিটা প্রায় খালি ।
মিলন সংঘের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ষষ্ঠী কে বললাম  অনুষ্ঠানের কথা ।ষষ্ঠীর ভালো নাম অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়।বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দাদা ।ষষ্ঠী খুবই আনন্দের সঙ্গে বা সানন্দে তা গ্রহণ করলো।শুধু তাই নয় , বলল ---সব দায়িত্ব আমার । আলো-পাখা সব ভরত ব্যবস্থা করে দেবে ।কল্যাণী  এন্টাপ্রাইজের কর্ণধার ভরত বাগ ষষ্ঠীর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ।
আমার  আর কোনো চিন্তা রইল না।আমি কার্ডের ম্যাটার রেডি করে ফেললাম।ছাপতে দেওয়া হল।

কার্ড ছাপার তা বিভিন্ন জনের হাতে দিয়ে দিলাম ।বেশির ভাগ কার্ড নিয়েছিল শান্তিময়।সুজিত হালদার কিছু নিয়েছিল ।বাকিটা ছিল  আমার কাছে ।
আমি  আমার পরিচিত জনদের নিজে গিয়ে  আমন্ত্রণ জানিয়ে আসলাম।সুতৃপ্তির সকলকেই কার্ড দিলাম ।প্রণবেন্দুদাকে নিজে গিয়ে বলে আসলাম ।
সুজিত জানালো চিত্রবাণী-র  অনেকেই আসবেন । এমনকি ফাদার  গাঁস্ত রোবের্জও আসবেন । এটা একটা বড়ো প্রাপ্তি, নিঃসন্দেহে ।
ইতিমধ্যে শান্তিময় বহরমপুরের সকলকেই জানিয়ে আসলো অনুষ্ঠানে আসার জন্য ।
বেশ একটা সাজো সাজো রব পড়ে গেল ।উত্তেজনায় টগবগ করে বুঝছিলাম আমরা সকলেই ।শান্তিময়ের মাধ্যমে নাসেরও জেনে গিয়েছিল কবিতা পাক্ষিক -এর প্রসঙ্গকথা।




৯৬.

প্রস্তুতিপর্বের আরো কয়েকটি কথা না বললে টোটাল পোয়েট্রির কনসেপ্ট টা ঠিক বোঝানো যাবে না ।
ভরত বাগ বলেছিল ওর গোডাউন থেকে  আলো-পাখা আনতে হবে ।আমার একটা ক্ষুদ্র আবদার ছিল,  একটা বড়োসড়ো ঝাড়বাতি চাই। আমি যে মনে প্রাণে একজন ফিউডাল  এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না ।
ভরত আমার সেই আবদার পূরণ করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে যাঁরা  উপস্থিত ছিলেন তাঁরা ঝাড়বাতি সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন।কারা উপস্থিত ছিলেন সেটা  অবশ্যই জানাবো ।তার আগে ছাপার পরে পত্রিকা কেমন দাঁড়ালো সেটা লিখে রাখা যাক।

কবিতা পাক্ষিক - এর ফাইলে জমা পড়া প্রথম কবিতাটি হল অলোক বিশ্বাস- এর অন্যকথা--১০ কবিতাটি ।
ত্রিপুরা হিতসাধিনী হলে সাহিত্যের আড্ডা -র বর্ষপূর্তি  উৎসব বা আড্ডা বসেছিল ২০ মার্চ ১৯৯৩ ।সেখানে এই কবিতাটি পাঠ করেছিল  আলোক । কবিতাটি পছন্দ হওয়ার জন্য ওর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া হয়েছিল।
অলোক বিশ্বাস ছাড়া  আর যাঁদের কবিতা ছিল, তাঁরা ---তারাপদ রায় ,শান্তিময় মুখোপাধ্যায়, রত্নেশ্বর হাজরা, মুহম্মদ মতিউল্লাহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়,দেবী রায়, নিয়াজুল হক, অজিত মিশ্র,  সমর সুর, সত্যসাধন চেল, সব্যসাচী সরকার, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, দীপশিখা পোদ্দার, অমলেন্দু ভট্টাচার্য ।
বাংলাদেশের কবিতা -পাতায় ছিল --- সুব্রত  অগাস্টিন গোমেজ এবং ফরিদ কবির- এর কবিতা ।অনুবাদ কবিতা -পাতায় ওক্ তাভিও পাজ- এর কবিতা  অনুবাদ করেছিল রবিশংকর বল আর ইন্দ্র নীল চক্রবর্তী ।
ভারতীয় কবিতা / তেলেগু থেকে অনুবাদ করেছিলেন কমলেশ সেন। বিশিষ্ট তেলেগু কবি কে  ভি আর -এর দুটি কবিতা অনূদিত হয়েছিল ।
ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলনের  অন্যতম প্রধান কবি কাননকুমার ভৌমিক - এর ওপর দায়িত্ব ছিল সমালোচনা - পাতার । কাননকুমার প্রথম সংখ্যাতে আলোচনা করেছিল---শ্যামলবরণ সাহা-র সাঁইত্রিশ কালনা রোড নামের কাব্যগ্রন্থটির।শেষ পৃষ্ঠায়  ছিল কবিতা সংবাদ ।সুজিত হালদারের নামে লেখাটি ছাপা হয়েছিল । ভাবতে পারেন ১ ফর্মা বা ১৬ পৃষ্ঠার মধ্যে এত বিষয়ের এত লেখা ।
নীল রঙের কাগজে, যেটা ফর্মার বাইরে, বাঁধাবার সময় পেস্ট করা হয়েছিল ।সেই নীল কাগজে  আমি লিখেছিলাম ---- কেন কবিতা পাক্ষিক ।
আমি  মান্যবর কবি বুদ্ধদেব বসুর একটা বাণী-কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলাম ।
বুদ্ধদেব বলেছিলেন ---- কবিতার জন্য পরিচ্ছন্ন  আর নিভৃত একটু স্থান করে দেবার জন্য কবিতা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন । আমি কবি বুদ্ধদেব - এর অপূর্ণ কাজটি করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলাম ।জানি না, কতটুকু পেরেছি বা পারলাম । এর বিচার করার কোনো অধিকার  আমার নেই ।আমার কাজ আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন, এর বেশি বলার অধিকারী আমি নই।
আমার লেখার শেষে কবিতা পাক্ষিক -এর একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল ।যাতে লেখা ছিল ---
মাসের প্রতি ২য় এবং৪র্থ শনিবার প্রকাশিত হবে।
বার্ষিক গ্রাহক মূল্য ---৫০ টাকা ।
প্রণবেন্দুদার এই পক্ষের ভাবনা -র নীচে ছাপা হয়েছিল ---
কবিতা পাক্ষিক -এর নামাঙ্কন সম্পর্কিত  একটি ঘোষণ।ঘোষণাটি পড়ে নিতে পারেন ।
তরুণ শিল্পী শিবু চৌধুরী কবিতা পাক্ষিক -এর জন্য কয়েকটি নামাঙ্কন করে দেন।সেগুলি থেকে বর্তমান  নামাঙ্কন টি নির্বাচন করেছেন---প্রফুল্ল রায়,প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, সমীরণ মজুমদার, মুকুল গুহ,  শ্যামলবরণ সাহা,শৌণক লাহিড়ী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, স্বপন সেন, রবিশংকর বল , শুভঙ্কর দাশ এবং জয় গোস্বামী ।
পত্রিকার  অনেক কিছু জেনে গেলেন, প্রকাশের আগেই ।
তাহলে আগামীকাল তো কবিতা পাক্ষিক -এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশের কথা লেখা যেতেই পারে ।




৯৭.

১৪০০ বঙ্গাব্দের ২৪ শে বৈশাখ ।আজকের দিনটি বাংলা পত্রপত্রিকার  ইতিহাসে সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিন। কেউ স্বীকার করুক বা না -করুক তাতে কিছুই যায়-আসে না । যাঁরা  এই বিষয়ে গবেষণা করবেন, তাঁরা কীভাবে অস্বীকার করবেন এহেন ধ্রুবপদটিকে ।সেটা তাঁদের ব্যাপার ।তাঁরাই ঠিক করবেন । এখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই ।
চা-পানের পরে ভরত বাগ -এর মহিম হালদার স্ট্রিটের গোডাউনে পৌঁছে গেলাম ।ভরত আগে থেকেই হাজির ছিল ।সবথেকে  অভিজাত ঝাড়বাতিটি পছন্দ করে দিলাম ।সঙ্গে দুটো পাখা। পেডেস্টরেল। ভরত জানালো এই ফ্যান দিয়ে স্টুডিওতে ঝড়ের দৃশ্য তৈরি করা হয়।কবিতা পাক্ষিক কতটা ঝড় তৈরি করেছিল তা তৎকালীন কবিসমাজের অজানা নয়।
পছন্দের কাজটি ছিল আমার । বাকিটা ভরতের। বা ষষ্ঠীর ।কেননা ষষ্ঠী ছিল প্রকৃত হোস্ট।নামেই আমরা ছিলাম ।সেই সময়ে কালীঘাট মিলন সংঘের পূর্ণ সমর্থন ছাড়া  এতবড়ো অনুষ্ঠান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হত না ।
এরপর বিশ্রাম  এবং স্বপ্ন -রচনা।
অতিথিদের মধ্যে প্রথমে  এসেছিলেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ।আমার বাড়িতে ।সেখান থেকে কালীঘাট মিলন সংঘের সভাগৃহে । তখন সেখানে  একেএকে আসতে শুরু করেছেন আমন্ত্রিত কবিরা । এসে উপস্থিত হলেন চিত্রবাণী-র টিম, ফাদার সহ।সুনীলদা তখনো এসে পৌঁছননি।সিদ্ধান্ত নিতে হল সুনীলদার পরিবর্তে ফাদার গাঁস্ত রোবের্জ কবিতা পাক্ষিক - এর প্রথম সংখ্যার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করবেন ।সেমতো,কিশোরী কৃষ্ণা বসু পুষ্প -স্তবক দিয়ে বরণ করে ফাদার গাঁস্ত রোবের্জ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত,  পবিত্র মুখোপাধ্যায় এবং অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অজিত ষষ্ঠীর ভালো নাম ।
ফাদার কবিতা পাক্ষিক - এর প্রথম সংখ্যার কপি তুলে দেন প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, ডঃ শ্যামলেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং নীতা দাশগুপ্তের হাতে।
এর ঠিক পরেই  এসে পড়েন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।সুনীলদাকে পুষ্প স্তবক দিয়ে করেছিলাম  আমি ।
সুনীলদা কবিতা পাক্ষিক প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা এবং পত্রিকা সম্পাদনা বিষয়ে তাঁর বক্তব্য বলেছিলেন ।
কবিতাপাঠের তালিকা দীর্ঘ হলেও তা লিখতে আমি বাধ্য ।কবিতাপাঠ করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, পবিত্র মুখোপাধ্যায়,কাননকুমার ভৌমিক, গোবিন্দ ভট্টাচার্য, নমিতা চৌধুরী, সমীরণ মজুমদার, প্রশান্ত গুহ মজুমদার,সত্যসাধন চেল,মানসকুমার চিনি, দিলীপ ভৌমিক, সৌমিত বসু,দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় , গৌতম চট্টোপাধ্যায়, অরূপ পান্তী, সোমনাথ রায়,নাসের হোসেন, রমেন  আচার্য, সুব্রত চেল, তমিস্রাজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,গোপাল আচার্য, শান্তিময় মুখোপাধ্যায় এবং আমি ।
আমি কবিতা পড়ার জন্য তৈরি ছিলাম না ।সুনীলদার চাপে পড়তে বাধ্য হয়েছিলাম ।
দীপ মুখোপাধ্যায়ের ছড়াপাঠ আসরকে মাতিয়ে দিয়েছিল। এতদিন পরেও দীপ-এর পাঠকরা ছড়াগুলো আমি শুনতে পাই ।
গল্পকার বলরাম বসাক,প্রলয় শূর এবং স্বপন সেন সহ রক্তকরবী সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য  অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে কবিদের উৎসাহিত করেছিলেন।
সংগীত পরিবেশন করেছিলেন স্বপন রায় এবং সুদক্ষিণা চৌধুরী ।
সুদক্ষিণা  আমার চতুর্থ ভাই বাবু বা আনন্দ -র স্ত্রী ।
সমগ্র  অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলাম অগ্রজ কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ।
অনুষ্ঠানের পর পরের দিনের রবীন্দ্র -প্রণাম নিয়ে কিছু প্রাথমিক  আলোচনা করে নিয়েছিলাম ।
আগামীকালের কথা আগামীকাল লেখা যাবে।




৯৮.

গতকালের লেখাতে উপস্থিতির দীর্ঘ তালিকা ছিল । কিন্তু সেখানে  আমার পরিবারের কারো নাম ছিল না ।যেগুলি লিখেছি সেই নামগুলি কবিতা পাক্ষিক -এর ২ নম্বর সংখ্যা থেকে টুকে দিয়েছিলাম মাত্র । নিজের স্মৃতিকে অবহেলা করেছি ।যা আমার  অন্যায় হয়েছে।
প্রথমেই যূথিকার কথা লেখা যাক।যূথিকা  আগাগোড়া উপস্থিত ছিল । ওর দায়িত্ব ছিল বাঁকুড়ার কবিজনদের  আপ্যায়ন করা।মেজভাই বা ডঃ দীপক চৌধুরীর নতুন একজোড়া চপ্পল কেউ পছন্দ হবার কারণে নিজের মনে করে নিয়ে গিয়েছিল ।পরিবর্তে সে রেখে গিয়েছিল তার ছেঁড়া একজোড়া হাওয়াই চপ্পল ।চোরারা যে অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান হয় এটা  আমাদের অজানা নয়। আমাদের জানাটাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এই ঘটনাটি । আর এহেন ঘটনা গতকাল লিপির বন্ধনে বাঁধা পড়েনি ।
আর শিবু, শিব চৌধুরী, যে আবার পত্রিকার নামাঙ্কন করেছিল,সেও আমার মতোই উদ্যোগী ভূমিকায় ছিল ।সারাক্ষণ সবদিকে লক্ষ রেখেছিল ।
বাবু অর্থাৎ আনন্দ চৌধুরীর স্ত্রী সুদক্ষিণা গান গেয়েছিল। আর বাবু যে ছিলই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না । এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, সুদক্ষিণা বা তপা-র বাপের বাড়ি রায়গঞ্জে।ওর বাবা রায়গঞ্জ ইউনিভার্সসিটি কলেজের  জনপ্রিয় অধ্যাপক ছিলেন ।তপা-র বাড়িতে গানের চর্চা ছিল ।অবশ্যই রবীন্দ্রগানের।
আর আমার বোনেরা সকলেই  আমার সমস্ত উদ্যোগকে সমর্থন করতো। খুকুর তখন বিয়ে হয়ে গেছে ।মেজবোন বুদো বা শুভ্রা তখন কি কাদাকুলির দেশের বাড়িতে ছিল, মনে পড়ছে না ।তবে পরের তিন বোন, দুর্গা - লকা -বুনি, বা শুক্লা -  শুভা,শ্বেতা--এই তিন জন কবিতা পাক্ষিক - এর যেকোনো অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতো।বিশেষত দুগ্গা বাংলা আকাদেমিতে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে খুবই তৎপরতার সঙ্গে আমার পাশে থাকতো।
ছোটোভাই বাপির খুবই ঘনিষ্ঠ কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়।কার্তিক মিলন সংঘের কর্মকর্তা । বাপি এবং কার্তিক দুজনেই সারাক্ষণ  আমন্ত্রিত দের দেখভালের দায়িত্বে ছিল । পরবর্তীতে বইমেলার জন্য যখন গাড়ি নিতে সমর্থ হয়েছিলাম, তখন কার্তিক প্রতিবার নামমাত্র ভাড়াতে গাড়ি দিত।সেসব কথা ভুলে যাইনি।সময় হলেই সব  উঠে আসবে নিজের দায়িত্বে,নিজ নিকেতনে ।অর্থাৎ এই লেখায়।

এবার ২৫ শে বৈশাখের প্রভাতী অনুষ্ঠানে যাওয়া যেতে পারে ।ভোরভোর বেরিয়ে   পড়লাম দু-দলে ভাগ হয়ে । সুব্রত চেল এবং যূথিকা গেল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি।আর বাকিরা অর্থাৎ আমরা রবীন্দ্রসদনের সামনে ভিক্টোরিয়ার মাঠে।তখন ওখানেই  অনুষ্ঠান হত। প্রথমেই যে-কটি জলের ,পানীয় জলের ট্যাঙ্ক বসানো হয়েছিল, সেগুলি কবিতা পাক্ষিক -এর ছাপানো পোস্টারে ঢেকে দিয়েছিলাম । ভেবেছিলাম, পোস্টারে ঢেকে দিলেই প্রভাতী অনুষ্ঠানটা কবিতা পাক্ষিক -এর হয়ে যাবে ।তা   হয়নি অবশ্যই, কিন্তু উপস্থিত সকলেই জেনে গিয়েছিল কবিতা পাক্ষিক - এর কথা।
অনেক পুরোনো বন্ধুজনের সঙ্গে দ্যাখা হয়েছিল ।সকলেই খুবই খুশি হয়েছিল। আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাশে থাকার ।
মাত্র  একশো কপি নতুন পত্রিকা নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাগের মধ্যে । এক ঘণ্টার মধ্যেই সবশেষ, নিঃশেষিত ।
আকাশবাণী কলকাতা -র সংবাদদাতা আমার ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিল ।আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম  এক সদ্য -যুবকের দিকে। আমি নয়,কবিতা পাক্ষিক -এর হয়ে সেদিন কথা বলেছিল নয়ন রায়।




৯৯.

সত্তর উচ্চারিত একটি কথা  এখনো মনের মধ্যে গেঁথে আছে কি ।গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলতে হবে ।যাঁদের  উদ্দেশ্যে বা লক্ষ করে কথাটা বলা হয়েছিল তাঁরা কতটুকু সার্থক হয়েছিলেন, তা বিচার করার কাজ আমার নয়। আদার ব্যাপারি আমি, জাহাজের খোঁজ করতে যাবো কেন । বরং একটা কথা  অকপটে নিবেদন করতে চাই, কবিতার ক্ষেত্রে এই বাণীটির সার্থক রূপায়ণ করেছিলেন কবি-সম্পাদক মণীন্দ্র গুপ্ত মশাই । তিনি সেসময়ে পরমা নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন ।সেখানে প্রাধান্য দিতেন জেলার / মফসসলের কবিদের । মূলত তাঁর একার চেষ্টায় পুরুলিয়া,  কৃষ্ণনগর, রানাঘাট সহ বিভিন্ন প্রান্তের কবিরা কেন্দ্রের বা কলকাতায় বসবাসকারী কবিদের সঙ্গে একাসনে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশের সময় মণীন্দ্র গুপ্ত গুরুত্ব দিতেন বাণিজ্য -সফল পত্রিকার কবিদের ।সেটা তাঁর মহত্বও বলা যেতে পারে । আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি পক্ষপাত দোষে আক্রান্ত ছিলেন না । এটাও তাঁর মহত্ব।

এরপর দীর্ঘদিন মফসসলের কবিরা  আর লাইমলাইটের আলোয় আসার সুযোগ পাচ্ছিল না ।যারা মফসসলের থেকে  উঠে এসে কলকাতাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল, তারা মফসসলের দিকে ঘুরে তাকাবার সময় পেত না,নানা ব্যস্ততার কারণে ।
আমি তখন  এতশত জানতাম না, বুঝতামও না । আমার মস্তিষ্কে ছিল সংগঠন -চিন্তা ।কবিতা পাক্ষিক - এর নিজস্ব সংগঠন ।কলকাতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে কবিতা পাক্ষিক -কে।কারণ কলকাতার জন্য পাতিরাম আছে ।রাসবিহারীর রমাপতিবাবু আছেন । কিন্তু  অন্যান্য জেলার কীহবে ।সেকারণে বেরিয়ে পড়তে হবে নিকটবর্তী জেলা সদরে।
সিদ্ধান্ত নেওয়া হল---কবিতা পাক্ষিক -এর বিভিন্ন সংখ্যার  আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে ভিন্ন ভিন্ন শহরে। এতে অনেক তরুণ কবিজনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে । প্রকাশ-যোগ্য লেখা পাওয়া অনেক সহজ হবে ।সাবলীল হবে ।

কবিতা পাক্ষিক ৩ - এ ঘোষণা করা হল ---
কবিতা পাক্ষিক -এর চতুর্থ সংখ্যা প্রকাশ উপলক্ষে কবি সম্মেলন ২৭ জুন, বিকেল ৪ টা য়, কবি উত্তম দাশের বাড়িতে,বারুইপুরে ।
তারও আগে হয়েছিল তৃতীয় সংখ্যার  আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, বাঁকুড়ার জেলা তথ্য কেন্দ্রে ।১৩ জুন, দুপুর ২ টোয়।
আমি  আগের দিন পৌঁছে গিয়েছিলাম কাদাকুলির বাড়িতে । সন্ধেতে উৎপল চক্রবর্তী -র সঙ্গে  আড্ডা গান,সবই হয়েছিল ।পরদিন দুপুরের খাওয়া টাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়েছিলাম।ছাঁদারে মোড় থেকে বাঁকুড়া যাবার বাস ধরেছিলাম ।পাত্রসায়র -সোনামুখীর থেকে আসা বাস।বেলেতোড়ে বসার সিটি পেয়েছিলাম ।চল্লিশ -পঞ্চাশ জন যাত্রী ছিল বাসটিতে।আমি ভেবেছিলাম এই বাসে কমপক্ষে কুড়িজন নিশ্চয়ই কবিতা পাক্ষিক -এর সভায় যাচ্ছে ।কারণ আমি তখনো পার্টি-মিটিং -এর মতোই মনে করতাম কবিসভাকে।পরে পরে সেই ভ্রান্তি দূরে সরে গিয়েছিল ।
বাঁকুড়ার ডি ও সি -র ওই কবি সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন  ঈশ্বর ত্রিপাঠী।কবিতা পাক্ষিক -এর পক্ষে বক্তব্য বলেছিলেন পবিত্র মুখোপাধ্যায় ,দীপ সাউ  এবং আমি ।কবিতা পাঠ করেছিলেন ---জ্যোৎস্না কর্মকার,সত্যসাধন চেল, বিশ্বনাথ দত্ত, সুব্রত চেল, প্রণব চট্টোপাধ্যায় ,চন্দন চৌধুরী, অগ্নিবর্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ,অনিন্দ্য রায়,নির্মল রায়,জয়দীপ মুখোপাধ্যায়, সচ্চিদানন্দ হালদার, বিশ্বজিত দত্ত, স্বরূপ চন্দ, বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অবনী নাগ এবং ঈশ্বর ত্রিপাঠী।সবশেষে পঠিত কবিতার ওপর আলোচনা করেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়।
এই সভার আহ্বায়ক ছিলেন---নির্মল রায়,সচ্চিদানন্দ হালদার, সত্যসাধন চেল, এবং
ডাঃ অমিতাভ চট্টরাজ।
আমার বিশ্বাস  ওই অনুষ্ঠানের মূল প্রচেষ্টা ছিল  সত্যসাধন চেল-এর।পবিত্রদা এবং আমি  উপস্থিত থেকে সভার শোভাবর্ধন করেছিলাম মাত্র।

সম্ভবত মিটিং-এর পরে আমরা দুজন চারণ কবি বৈদ্যনাথ - এর ক্ষণিকের অতিথি হয়েছিলাম।শুদ্ধাচারে পান  করেছিলাম কারণবারি।লালশালু- করোটি যাবতীয় উপাচার যথাস্থানে ছিল ।
মধ্যরাতে বাঁকুড়া স্টেশন থেকে ফেরার ট্রেন ধরেছিলাম ।
বাথরুমের পাশে মেঝেতে খবরকাগজ পেতে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম ভাগ্যক্রমে ।
কবিতা পাক্ষিক -এর জন্য  পবিত্রদার এই ক্লিষ্টসাধন ভুলে গেলে অন্যায় হবে।



প্রভাত চৌধুরী